‘সংশয়’ শব্দটি নিয়ে আমার খুব আপত্তি আছে। আর যদি ‘সংশয়’ শব্দটির ব্যবহার হয় মানুষে মানুষে কোনও একটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে তবে সে আপত্তি মাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়।
সংশয় অর্থ তো সন্দেহ কিংবা দ্বিধা। তাহলে কোনও একটি সম্পর্কে সন্দেহ কিংবা দ্বিধা- সর্বোপরি সংশয় কেন থাকবে? কিন্তু আছে, থাকেও। সকলের থাকে কিনা আমি জানি না, আমার থাকে।
সংশয়ের আরও দুটি অর্থ আছে, অবিশ্বাস ও ভয়। অথচ দেখুন, যে কোনও সম্পর্কের ভিত্তিটিই কিন্তু বিশ্বাস। তাহলে যে সম্পর্কে অবিশ্বাস আছে তাকে কি যে কোনও সম্পর্কের কোনও অভিধায় অভিহিত করা যাবে? এই জায়গাতে আপনি হয়ত বলবেন, শত্রুতার সম্পর্কে অবিশ্বাস থাকে। আপনার অবগতির জন্যে বলতে চাই, ‘শত্রুতা’ যে একটি ‘সম্পর্ক’ সেটি আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া কারও সঙ্গে আমার এই বিশেষ ‘সম্পর্ক’টি নেইও আসলে। আপনি হয়ত ‘প্রতিপক্ষ’ বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু ‘প্রতিপক্ষ’ তখনই হয় যখন আপনি কোনও প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবেন। আমি তো কোনও প্রতিযোগিতায় নামি নি! তার সময় কোথায় বলুন তো! পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজের মতো বসবাস করতে গিয়ে যে পরিমাণ ছোটাছুটি করতে হয় – তার জন্যে তো পুরো দিনটিই যথেষ্ট নয়! প্রতিযোগিতা করব কখন! কার সঙ্গে করব! কেনই বা করব বলুন তো!
আর বাকি রইল ভয়। ক’দিন আগে শরীরটা খুব এলোমেলো হয়েছিল। আমি তখন খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভয় পাওয়ার পর প্রথমে খুব লজ্জাও লেগেছিল। পরে মনে হলো, নাহ্, এই ভয় পাওয়াটা ঠিকই আছে। এবং অমন বাস্তবতায় পড়লে আপনিও ভয় পেতেন। এবং এই ভয় পাওয়াটা দরকারিও। ভয় পেয়েছিলাম বলেই ছুটে গিয়েছি হাসপাতালে, জানতে চেয়েছি শরীরটার আদ্যপান্ত। তারপর ক’দিনের টানা বিশ্রাম। বিশ্রামের সময়টাতে নানা ভাবনা এসে ভিড় করে। এখন যেমন এল।
‘বন্ধু’ শব্দটিতে আমার ভীষণ শ্রদ্ধা। কিন্তু আমি খুব ঘটা করেই বলি, আমার তেমন বন্ধু নেই। না থাকার কারণ হলো, বন্ধুত্ব যে গভীরতা দাবি করে সেটি এ যুগের ফ্রেন্ডলিস্টের যারা- তারা কখনও মেটাতে পারবে না। বন্ধুকে আমরা জেনে এসেছি নিজেরই আরেকটি সত্তা হিসেবে। আমি আমার নিজেকে যতটা জানি, আমার বন্ধুটিকেও ঠিক ততটাই জানি। বন্ধুটিও তাই, নিজের মতো করে আমাকেও সে জানে। একসময় আমার অনেক বন্ধু ছিল। এখন নেই। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই এসে তাদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমার বন্ধুর তালিকাটি এখন তাই অনেক সংকুচিত।
সেকারণেই কিনা জানি না কেউ যখন এসে আমাকে তার বন্ধু বলে দাবি করে, আমি চমকে উঠি। এই চমকে ওঠাটা কি ভয় আসলে? হতেও পারে। আমি তখন ভাবতে থাকি, ইনি আমার বন্ধুত্ব দাবি করছেন কেন? কতটুকু চেনেন আমাকে? আমি তো তাকে চিনি না! তাহলে! একটা সংশয় এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে আমাকে। মানুষকে অবিশ্বাস করতে খারাপ লাগে আমার। কিন্তু বিশ্বাসও যে করতে পারি না! তবে বিশ্বাস করতে চাই। সমাজবদ্ধ জীব যে!
আজই পৃথিবীর মানুষের সংখ্যা আটশ’ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াল। এই আটশ’ কোটি থেকে আমার গুটিকয় বন্ধু থাকবে না- এ কেমন কথা!