রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িকতায় রাজনীতি

0 comment 106 views

কয় সপ্তাহ আগে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্নাটক রাজ্যে কয়টি কলেজ ঘোষণা দিয়ে ফেলল মুসলমান মেয়েরা হিজাব পরতে পারবে না।  এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ দাবি করল হিজাব নাকি ইউনিফর্ম নীতিবিরুদ্ধ। তারপর ক্লাসের ভেতর হিজাব পরা নিষিদ্ধও করে দিল। এ খবর যেদিন পত্রিকার পাতায় প্রথম দেখতে পেলাম, আমার বিশ্বাস হয় নি, সেকারণে খবরটিকে তেমন পাত্তাও দেই নি। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানে থেমে থাকে নি। আরো বেড়েছে। পত্রিকার পাতায় ছবি ছেপেছে, কলেজ কর্তৃপক্ষ হিজাব পরা মুসলমান ছাত্রীদেরকে কলেজে ঢুকতে দিচ্ছে না, কলেজের মূল ফটকে আটকে দিয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের খবরটি চাউর হবার পর ভারত জুড়ে ভীষণ সমালোচনার শুরু হয়ে গেল।

কিন্তু ভারত সরকার সেটিকে আমলে নিল না। এর ফলে হিজাবের বিরুদ্ধে গেরুয়া রঙের চাদর আর ওড়না পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাচ্চা বাচ্চা শিক্ষার্থীরা হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করতে শুরু করে দিল। কথা হলো, ভারতে মুসলমান সম্প্রদায় তো নতুন করে বসবাস করতে শুরু করে নি। মুসলমান মেয়েরাও হঠাৎ করে একদিন হিজাব পরে আচমকা স্কুল-কলেজে যেতে শুরু করে নি। মুসলমান ও হিজাব- দুইই খুব খুব প্রাচীন। অথচ এইটি নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে অনাবশ্যক বিতর্ক আর উত্তেজনা। যেসব মেয়েরা হিজাব পরে লেখাপড়া করতে কলেজে যায় তাঁদের বেশ ক’জনা মিলে ধর্মীয় আচারের স্বাধীনতা চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হলো। রাজ্য সরকার তখন স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিল। কর্নাটকের দেখাদেখি বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেল মধ্যপ্রদেশ, পুদুচেরি, দিল্লি, কলকাতাসহ আরো বেশ কিছু রাজ্য ও শহরে। তারপর অবাঞ্ছিত এই বিতর্ক ছড়িয়ে পড়তে লাগল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। এককথায় কর্নাটকের হিজাব-বিতর্কের আন্তর্জাতিকীকরণ হয়ে গেল। সে সমালোচনা ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে পৃথিবীর নানান দেশে ছড়িয়ে পড়তেও লাগল। ব্যাপক ক্ষোভ আর সমালোচনার ঝড় উঠল।

বিষয়টা একটু লক্ষ্য করুন, পুরো ব্যাপারটাকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বলে মনে হচ্ছে না? না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এরই মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অনেকেই ভারতের দিকে আঙুল তুলেছেন। তুলবেনই। তোলাটাই স্বাভাবিকতা। কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক নয়, রাজনৈতিক। আসলে সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপারটা তো রাজনীতিই। এরই মধ্যে কর্নাটকের হিজাব বিতর্ক ও ভারতে বাড়ন্ত ইসলামভীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা-ওআইসি। আসাউদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, হিজাব পরা নারীই একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। অন্যদিকে কর্নাটকের কংগ্রেস বিধায়ক জমির আহমেদ বলেছেন, নারীরা হিজাব পরেন না বলেই ভারতে ধর্ষণের হার সবচেয়ে বেশি। কলকাতায় শত শত শিক্ষার্থী কর্ণাটকে হিজাব নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে মিছিলে স্লোগান দিয়ে রাস্তা অবরোধ করেছে।

বিষয়টা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার মতোই রাজনৈতিক। মুঘল সম্রাট বাবরের আদেশে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যাতে সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮-২৯ সালে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। সেকারণেই মসজিদের নামকরণ করা হয় বাবরি মসজিদ। ১৯৯২ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর তাদের সহযোগী সংগঠনের হিন্দু কর্মীরা ষোড়শ’ শতাব্দীতে নির্মিত প্রাচীন ঐতিহ্যের এ স্থাপনাটি ভেঙে ফেলল। ভেঙে ফেলার কারণ হিসেবে তারা বলল, হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী অযোধ্যা হলো রামের জন্মভূমি।

পৌরাণিক উপাখ্যানের প্রধান উৎস ঋষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ হলো মহাকাব্য। উপাখ্যান মানে হলো কাল্পনিক কাহিনী। আমরা যাকে রূপকথা বলি আর কি। এইই পুরাকাহিনী বা পৌরাণিক উপাখ্যান। রামায়ণও তাই। রামায়ণের প্রধান চরিত্র রাম। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এইচ. ডি. শঙ্কলিয়ার বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রামায়ণ রচিত হয়। রামের আরেকটি পরিচয় হলো তিনি হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোয় রামকে অযোধ্যার রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রাম। হিন্দুধর্মে তিনি একজন জনপ্রিয় দেবতা। কয়েক বছর আগে ভারতে চন্দন কুমার সিং নামে এক আইনজীবী এই দেবতা রামের নামে মামলা করে দিয়েছিলেন। দেবতা রামের বিরুদ্ধে চন্দন কুমারের অভিযোগটি ছিল রাম তাঁর স্ত্রী সীতার প্রতি অন্যায্য আচরণ করেছেন।

বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার বিষয়ে ভারতীয় কলামিস্ট গৌতম রায় লিখেছেন, ‘ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস বা সেই ধ্বংসস্তুপের উপরে মন্দির তৈরি এগুলির কোনোটার সঙ্গেই ধর্ম বা আধ্যাত্মিক চেতনার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক কোনোদিন ছিল না। নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন; হিন্দুত্ব, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, মুসলিম বিদ্বেষ-এগুলির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাবরি মসজিদকে বোড়ের দান হিসেবে নিয়েছিল আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলসহ গোটা সঙ্ঘ পরিবার এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। মসজিদ ধ্বংসের ভিতরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনো ধর্মীয় দ্যোতনাই ছিল না। কারণ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই অপর ধর্মের উপাসনালয় ধ্বংস করে সেখানে নিজের ধর্মের স্থাপত্য নির্মাণকে সমর্থন করে না। হিন্দুত্ববাদীদের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পিছনে একমাত্র কাজ করেছিল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের তাগিদ। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী ঘটনাক্রমে হিশেবে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সাম্প্রদায়িকতাকে হিন্দুত্ববাদীরা এমন একটা স্তরে এনে ফেলতে পেরেছে, যার জেরে পর পর দুইবার, একক গরিষ্ঠতা নিয়ে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে।’ (বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রাজনীতি- গৌতম রায়।) এখন বিজেপির পরপর দু’বার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসাটাকে আপনি সাম্প্রদায়িকতা বলতে পারেন। কেননা একক গরিষ্ঠতা নিয়ে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে পারা মানে হলো, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট পাওয়া। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমর্থন করছে। তাহলে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিশ্চয়ই বুকের গহীনে সাম্প্রদায়িক ভাবনা লালন করেন। এবং সুযোগ পেলে সে সাম্প্রদায়িকতার প্রতি তার যে সমর্থন, সেটি প্রকাশও করেন। তাদের সে প্রকাশের ফলাফলেই বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক একটি দল পরপর দু দু’বার একক গরিষ্ঠতা নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পিছনে একমাত্র কাজ করেছিল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা- এইটিই আসলে মূল কথা। তো উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা হলো দেবতা রামের জন্মস্থান বলে এখানে কোনো মসজিদ থাকতে পারবে না- এইটি আসলে বিজেপির একলার কথা না, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদেরই কথা। সেকারণে অযোধ্যাকে দেবতা রামের জন্মস্থান দাবি তুলে চারশ’ বছর পুরনো ঐতিহ্য বাবরি মসজিদটি ভেঙে ফেলা হলো। এবং এই ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়েই আজকের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি লাইম লাইটে এল। অথবা আপনি একটু ঘুরিয়েও বলতে পারেন- লাইম লাইটে আসতেই তারা চারশ’ বছর পুরনো ঐতিহ্যটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল। এর মানেটা তবে কি দাঁড়াল? মানেটা দাঁড়াল, দেবতা রাম কিংবা বাবরি মসজিদ আসলে কোনো অর্থ বহন করে না। অর্থ বহন করে রাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে কিভাবে দৃঢ় করা যায় সেটিই। আর এই কাজটি করতে ধর্মকে অত্যন্ত নগ্নভাবে ব্যবহার করতে পারা। এবং আমাদের উপমহাদেশে এই ব্যবহারটি অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে হয়, হয়ে এসেছে, হবেও। কেননা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার তো নতুন কিছু নয়। এইটিও একটি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য।

১৯৪৭-এ তো দেশভাগ হলো। দেশভাগের কারণটি সকলে জানলো, হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের বিরোধিতা। হ্যাঁ, বিরোধিতা ছিল বটে, কিন্তু সে বিরোধিতা হিন্দু-মুসলমানের স্বপ্রণোদিত ছিল না আসলে। হিন্দু আর মুসলমানের ভেতরে বিরোধটি রোপণ করে দিয়ে তাদেরকে প্ররোচিত করা হয়েছিল। আর একাজটি অত্যন্ত সুনিপুণ আর সুপরিকল্পিতভাবে করেছিল ব্রিটিশরা। তারা এমনভবে দু পক্ষকে উসকে দিল যে ওই দু পক্ষ একে অপরের সঙ্গে ভীষণভাবে রাগ হয়ে গেল। সে রাগ প্রকাশও করতে লাগল। ফলে দেশটাকে কেটে দুটা ভাগে ভাগ করে ফেলাটা অনিবার্য হয়ে পড়ল। আর এই অনিবার্যতার সুযোগটি নিয়ে নিল জিন্নাহ।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা লোকটির নাম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ। দেশটা ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। আসলে ধর্মকে পুঁজি করে। জিন্নাহ বলেছিল, ভারত হিন্দুর দেশ। আর পাকিস্তান হবে মুসলমানের দেশ। নিজেকে জিন্নাহ মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতা বলেই মনে করতেন। দাবিও করতেন। সেকারণেই লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে আবদার করে পূর্ব বাংলাকেও পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে নিলেন। পূর্ব বাংলাকে বানালেন পূর্ব পাকিস্তান। এরপরের ইতিহাস তো কেবলই শোষণ আর নিষ্পেষণের ইতিহাস। আর নিজভূমে পরবাসীর মতো পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি হলো দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। এরপর বাঙালিরা একদিন এর প্রতিবাদ করল।

তারপর এল একাত্তর। এল পঁচিশে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট। এও রাজনীতিই বটে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনী এল বাঙালিকে মেরে শেষ করে দিতে। করতে শুরুও করল। পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় সরকার বিজ্ঞাপন দিল, পূর্ব পাকিস্তানে জিহাদ চলছে, হে সুনাগরিকগণ, তোমরা অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করো। দেখুন, এখানেও রাজনীতি। সঙ্গে ধর্মের ব্যবহারে সুনাগরিকগণেরা সহযোগিতা করলও। আর সে অর্থ সহযোগিতায় পুষ্ট হয়ে পাকসেনারা এদিকে চালাতে লাগল গণহত্যা আর ধর্ষণ। পরিকল্পনাটি ছিল বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। লক্ষ্যটি সম্পদ ও ক্ষমতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করবার আগেই মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি হবেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। হয়েওছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যদি বাঙালির বিজয় না হতো তাহলে কারা কারা আর কত কত লোকে যে কত কিছু ঠিক করে রেখেছিল তার খবর আর কোনোদিনই জানা হবে না।

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্নাটক রাজ্যের কলেজগুলোতে যে মুসলমান মেয়েরা হিজাব পরতে পারবে না বলে যে ঘোষণা দিয়ে ফেলল, এর পেছনে কারা আছে তার খবরটি কি জানা যাবে? না, বিজেপির কথা বলছি না। বিষয় হলো, বিজেপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে বলেই তো ধর্মকে ব্যবহার করা সহজ হয়েছে। বলছি ধর্মকে এভাবে ব্যবহার করা লোকেদের কথা। কারা তারা? কলেজগুলোর রাজনীতি করা শিক্ষকরা? নাকি কোনো জনপ্রতিনিধি?

যদিও সমালোচনা করতে পারা নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার, তবু বাংলাদেশেও আজকাল একটা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এরা সরকারের সমালোচনা করা যায় বলে মানতে রাজি না। সরকারের সমালোচনাকে এরা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য করে। তেমনি ভারতে তো সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ফলে ধর্মীয় আক্রমণকারীরা বিজেপিরই ন্যাওটা হওয়ার কথা। কিন্তু কারা এরা? এদের রাষ্ট্রিক আর সামাজিক পরিচয়টি কি?

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing