বাংলাদেশে আমরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপন করি। এই উদযাপনটি হলো, দীর্ঘ নয়টি মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তান বাহিনী আমাদের কাছে পরাজয় মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল- সে উদযাপন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটি আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছিল ২৬ মার্চ। ২৬ মার্চ আমরা ঘোষণা দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিলাম- আজ থেকে আমরা আর পূর্ব পাকিস্তান নই। আজ থেকে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি দেশ। আমাদের দেশটির নাম বাংলাদেশ।
বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে দেশের জন্যে যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁদেরকে স্মরণ করি। তাঁদের স্মৃতিসৌধে ফুল দিই।
আমেরিকায় দেশের জন্যে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদেরকে নিজেদের মতো শ্রদ্ধা জানাতে আলাদা একটা দিন রাখা হয়েছে। এই দিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেমোরিয়াল ডে’। আমেরিকা তো স্বাধীন হয়েছে আজ থেকে ২৪৭ বছর আগে, ১৭৭৬ সালে। দিনটি ছিল জুলাই মাসের দ্বিতীয় দিন। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় ৪ জুলাই। সে ভিন্ন গল্প।
আজকে আমেরিকায় একটি বিশেষ দিন। আসলে বলা ভালো ঐতিহাসিক দিন। আজ মেমোরিয়াল ডে। বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘স্মরণ দিবস’। মেমোরিয়াল ডে পালন করার জন্যে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নির্ধারণ করা নেই। দিবসটি পালন করা হয় ‘দিন’ হিসেবে- প্রতি বছর মে মাসের শেষ সোমবারটিকে মেমোরিয়াল দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এই রীতি ১৯৭১ সাল থেকে।
১৯৭১ সালে কংগ্রেস মেমোরিয়াল ডে-তে জাতীয় সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে। শুরুতে মেমোরিয়াল ডে-কে ‘ডেকোরেশন ডে’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। আর পালন করার জন্যে মে মাসের ৩০ তারিখকে নির্ধারণ করা হলো। ৩০ মে ডেকোরেশন ডে পালন অনেক বছর চলেছিল। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘ডেকোরেশন ডে’ বদলে গিয়ে ‘মেমোরিয়াল ডে’ নাম ধারণ করল।মজার ব্যাপার হলো মেমোরিয়াল ডে থেকে বেসরকারি ভাবে গ্রীষ্মকাল শুরু হলো ধরে নেওয়া হয়।
আমেরিকার ইতিহাসে সামরিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যারা মারা গেছেন- মেমোরিয়াল ডে-তে তাদেরকে স্মরণ করা হয়। দেশের জন্যে প্রাণ দেওয়া সেইসব সৈনিকদের কবরে ফুল দেওয়া হয়। পুরো কবরস্থান ফুল আর জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়।
দেশের জন্যে যারা নিজের প্রাণ বিলিয়ে দেন তাঁদেরকে সম্মান জানানো একটি প্রাচীন প্রথা। অ্যাথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস- যার সময়কে গ্রিসের গণতন্ত্রের স্বর্ণযুগ বলা হতো, তিনি ভাষণে বলেছিলেন যুদ্ধে যারা হতাহত হন তারা যোগ্য পুরুষ। পেরিক্লিস মনে করতেন “জীবিতদের জন্য তার চাইতে বড় কোনো সাহসিকতার চেতনা আর হতে পারে না।”
মেমোরিয়াল ডে-তে জাতীয় সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। এদিন আমেরিকার সর্বত্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই চেতনায় ভাষণ দেওয়া হয় এবং কয়েক মুহূর্ত নীরবতা পালন করা হয়। আমেরিকার সর্বত্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একই চেতনায় ভাষণ দেওয়া হবে এবং কয়েক মুহুর্তের জন্য নিরবতা পালন করা হবে। শহরে সাঁজোয়া যানে বর্ণাঢ্য প্যারেড ও স্মৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে প্রায় আড়াইশ’ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখার জন্য বিভিন্ন যুদ্ধে যে হাজার হাজার নাম না জানা আত্মোৎসর্গ বীরদের স্মরণ করা হয়।
এদের অনেকে মারা গেছেন যুদ্ধে, কেউ নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে। অনেকে হারিয়ে গেছেন ভিনদেশী কোনো কারাগারে- যারা আর কোনোদিন ফিরে আসেন নি। সবচয়ে মর্মান্তিক সত্যটি হলো, তাদের অধিকাংশই মারা গেছেন খুব অল্প বয়সে। দেশের আদর্শ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এরা এত অল্প বয়সে মারা গেছেন যে সে বয়সে তারা ওই সব আদর্শ পুরোপুরি উপলব্ধিও করতে পারেন নি। উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে লক্ষ লক্ষ সৈনিক লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্যদের মুক্ত করতে যেয়ে।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হলো, মেমোরিয়াল ডে কোনো বিশেষ লড়াই বা যুদ্ধকে সম্মান প্রদর্শন করতে পালিত হয় না। এই দিনটির অর্থ বীরত্ব ও স্মৃতিসৌধের বাইরে ছড়ানো। এই দিনটি হলো এখন যারা বেঁচে রয়েছেন, পুরো জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতার একটি নিদর্শনের নাম মেমোরিয়াল ডে। এই দিনটিতে সকলে মিলে দেশের সূর্যসন্তাদের জানায়, স্বাধীনতা রক্ষায় তাঁদের যে আত্মত্যাগ, সে ত্যাগ বৃথা যায় নি। এই যে দেখ, আমরা আছি। আমরা তোমাদের দেওয়া পতাকা সমুন্নত রেখেছি, রাখবও— এই দিনটি তারই স্বীকৃতি।
সকল দেশের সকল সময়ের সূর্যসন্তানদের জন্যে নগণ্য এই আমার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা।