মুসলমানদের বিরুদ্ধে মোদির লড়াই

0 comment 51 views

ভারতীয় কলামিস্ট শশী থারুর একটি কলাম লিখেছেন, কলামেরর শিরোনাম ‘মোদি’স অ্যান্টি-মুসলিম জিহাদ’। শশী থারুর অবশ্য কেবল কলাম লেখক নন। তার আরও বেশকিছু পরিচয় রয়েছে। তিনি জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী, এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন এমপি।

তো শশী থারুর তার কলামে মোদির মুসলিমবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের মুসলমানদের নিধনের লড়াইয়ে নেমেছেন। মোদি ভারতের হিন্দুত্ববাদকে ভারতের হিন্দুত্ববাদকে নতুন প্রাণে সঞ্চারিত করে উসকে দিয়ে ২০০১ সালে গুজরাটে দাঙ্গা বাধিয়ে হাজার হাজার মুসলমান হত্যায় সহযোগিতা করে লাইম লাইটে এসেছেন। তারপর নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী বনে যান। যার ফলে পরবর্তীতে মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। এরপর থেকে তিনি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রীতিমত জাতীয়ভাবে নির্যাতনের শিকারে পরিণত করেন। যার কারণে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপুল সমর্থন অর্জন করে ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন।

মোদি ও তার রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং সন্ত্রাসী দল ‘আরএসএস’ ভারতজুড়ে দ্বিগুণ উৎসাহে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, যার সর্বশেষ সংস্করণ হলো হিন্দু উগ্রবাদী নেতাদের মুসলমানদেরকে গণহত্যার আহ্বান জানানো এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছাত্রীদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পোশাক হিজাবকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা।

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা আসামে মুসলিম নিধনের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। রাজ্য সরকার হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে মুসলমান উচ্ছেদের অভিযান শুরু করেছে । নথিপত্র সূত্রে প্রমাণিত, মুসলমান নাগরিকদের তারা ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আশ্রয় নেয়া শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করছে। রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ তথা ২০ লাখ মুসলমান এই অভিযানে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে শরণার্থীবিষয়ক আইন চালু করে মুসলমানদেরকে বাদ দিয়ে অন্য পাঁচটি ধর্মাবলম্বীদেরকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। এই নাগরিকত্ব পর্যালোচনার নামে প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার মানুষকে নাগরিকত্ব হরণ করা হয়, যার বেশিরভাগই মুসলমান।

তারপর শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। এসব মুসলমান জনগোষ্ঠীকে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে সে জমিতে ভূমিহীন হিন্দু সম্প্রদায়কে পুনর্বাসন করা হয়। সম্প্রতি আসামের দরং জেলায় ধলপুর হিলস ও সিপাহঝাড় এলাকায় ৭৭ হাজার বিঘা জমি থেকে মুসলমান নাগরিকদের উচ্ছেদ করে একটি প্রাচীন শিবমন্দিরকে দেওয়া হলো বড় আকারের মন্দির কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য। এই প্রকল্পের কারণে প্রায় আটশ’ পরিবারের বেশ কয়েক হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করা হয়েছে। উচ্ছেদের প্রতিবাদ করলে পুলিশ গুলি করে দু’জন মুসলমান প্রতিবাদকারীকে হত্যা করে।

২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর মোদি সরকার সংসদে নাগরিকত্ব আইন পাস করে। এই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে নির্যাতনের শিকার অমুসলিম নাগরিকরা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করলে তারা সবাই ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রাপ্তির উপযোগী বলে বিবেচিত হবে। বৈষম্যমূলক এই আইন প্রকৃত অর্থে মুসলমানবিরোধী আইন। এতে ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু নাগরিকরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে। অন্য দিকে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের রাষ্ট্র এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অপমান করা হয়েছে।

মোদির বর্ণবাদী আচরণ মুসলমান নাগরিকদের কোণঠাসা করে ফেলেছে। বর্তমান ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে একটিতেও মুসলমান মুখ্যমন্ত্রী নেই। ১৫ রাজ্যে একজনও মুসলমান মন্ত্রী নেই। ১০ রাজ্যে একজন করে মুসলমান মন্ত্রী আছেন, যাদের দায়িত্ব হলো সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেখভাল করা। লোকসভায় বিজেপির ৩০৩ সদস্যের একজনও মুসলমান নন।

সম্প্রতি আসামে মাদ্রাসা শিক্ষা আইনকে সংশোধন করে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মাদ্রাসাগুলোতে ইসলামি শিক্ষা বন্ধ করে সাধারণ স্কুল কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম সম্প্রদায় আদালতে গেলে হাইকোর্ট সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। দেওবন্দ মাদ্রাসার ওয়েবসাইট থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের শিশুবিষয়ক দু’টি ধর্মীয় ফতোয়া স্থানীয় প্রশাসন বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য দিকে বিশ্বখ্যাত দেওবন্দ মাদরাসার বিরুদ্ধেও কৌশলে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। দেওবন্দ মাদরাসার পাশেই গত জানুয়ারিতে সন্ত্রাসবাদবিরোধী ‘প্রশিক্ষণকেন্দ্র’ স্থাপন করে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীদের বার্তা দিতেই এই কেন্দ্র খোলা হয়েছে।’

মুসলমান বিদ্বেষ থেকে রক্ষা পায় নি স্থানের প্রাচীন নামও। দক্ষিণ দিল্লির পৌর করপোরেশনের অধীনে একটি গ্রামের নাম ‘মোহাম্মদপুর’, সে গ্রামটির নাম বদলে দিয়ে এখন ‘মাধবপুরম’ করার প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকারের রাজস্ব বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এর আগে ‘আলিগড়’-কে পরিবর্তন করে ‘হারগড়’; ‘মঈনপুরী’-কে ‘মায়ান নগর’; ‘এলাহাবাদ’-কে ‘প্রয়াগরাজ’; ‘মুঘলসরাই’-কে ‘দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর’ ও ‘ফৈজাবাদের’ নাম বদলে ‘অযোধ্যা’ করা হয়েছিল।

এছাড়া মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরকে হিন্দুত্ববাদে আনতে ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্ট একতরফাভাবে সংবিধানের ৩৭০নং ধারা অবলোপন করে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন এবং বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করে। পরে ২০২০ সালের ১ এপ্রিলে করোনা মহামারীর অন্তরালে গভীর রাতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে কাশ্মিরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়।

কাশ্মির ছাড়া ভারতের একমাত্র মুসলিমপ্রধান এলাকা লাক্ষাদ্বীপ। সেখানে ৯৮ শতাংশ অধিবাসীই মুসলমান। লাক্ষাদ্বীপে স্কুলগুলোর ছুটির দিন ছিল শুক্রবার। শিক্ষা বিভাগ শুক্রবারের সে ছুটির দিন বাতিল করা হয়েছে। গরুর মাংস খাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা, হোটেল-রিসোর্টগুলোতে অ্যালকোহল বৈধ করে দেওয়া, স্কুলে মিড ডে মিলে শুধু নিরামিষ খাবার দেয়া, দুইয়ের অধিক সন্তানের বাবা-মাকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করাসহ নানান মাধ্যমে ৯৮ শতাংশ মুসলমানের এই অঞ্চলে ব্যাপক নির্যাতনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে

বিদ্যমান ইসলামি শরিয়ত, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অপমান করে, হিন্দুত্ববাদকে উসকে দিয়ে কর্নাটকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দিয়ে মুসলমান ছাত্রীদের হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্রীরা আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালতও হিন্দুত্ববাদী আচরণ করে। আদালত মামলা নিষ্পত্তির আগে পর্যন্ত উল্টো নতুন বিধি মেনে চলার আদেশ বহাল রেখে হিজাব না পরার নির্দেশ দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব খুলতে বাধ্য করা হচ্ছে।

সার্বিক বিচারে ভারতের সাধারণ জনগণের মধ্যে ‘মুসলমান ভীতি’ না থাকলেও মোদির রাজনৈতিক দল বিজেপি মুসলিম ভীতিটাকে পুঁজি করে রাজনীতি করে চলেছে। বিজেপির মূল সংগঠন ‘আরএসএস’ এই মুসলমান নির্যাতনের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়ন করছে। মোদি নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক দেখেই ভারতের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ বা আন্দোলনকে চিহ্নিত করতে হবে। ‘বিজেপি’র শীর্ষ নেতা অমিত শাহ বাংলাদেশী মুসলিম অভিবাসীদের উইপোকার সাথে তুলনা করে এদের একটি একটি করে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার প্রতিজ্ঞা করেছেন বলে খবরের কাগজে খবর এসেছে।

নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ভারতে এখন ইসলাম ভীতি সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নিয়েছে। দেশটির প্রায় ২৫ কোটি মুসলমানকে নির্যাতিত সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে। মোদি ও বিজেপি সরকার গঠনের আগে এত মুসলমান নির্যাতন ভারতে হয় নি কখনও। নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপি ক্ষমতায় আসতেই মূলত মুসলমানদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। মুসলমানদের নির্যাতনে হিন্দুত্ববাদকে উসকে দিয়ে ভোট সংগ্রহই মোদি ও বিজেপির মূল উদ্দেশ্য। এই রাজনীতি করেই মোদি ক্ষমতায় এসেছে এবং এই রাজনীতিকে ক্রমাগত ব্যবহার করেই ক্ষমতায় টিকে থাকবার পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই নীতি হবে ভারতের জন্যেই আত্মঘাতী। ভারত তার গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়টি হারিয়ে পরিচিতি হয়ে উঠবে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing