একটা গল্প বলি।
একবার হলো কি ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে এক গির্জার বাগানে গিয়ে ঢুকেছে। ছেলেটার হাতে কয়েকটা পাইন গাছের চারা। বাগানে তখন মালি গাছের পরিচর্যা করছিল। ছেলেটা মালির কাছে গিয়ে পাইন গাছের চারাগুলো দিয়ে বলে, এই চারাগুলো নিয়ে আমাকে কিছু পয়সা দেন।
মালি লোকটা কিছু বলল না। গাছগুলো নিয়ে পকেট থেকে কিছু পয়সা বের করে ছেলেটিকে দিয়ে দিল। ছেলেটি পয়সা নিয়ে চলে যেতে মালি চারাগাছগুলো গির্জার পাশে পুঁতে দিল।
ক্রিসমাসের দিন সকালে ঘুম ভেঙে মালি দেখে কি পাইন গাছগুলো বড় হয়ে গির্জাকে ছাড়িয়ে আরও অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। মালি খুব করে বিস্ময় নিয়ে দেখে সেসব গাছ থেকে অজস্র তারার মতো আলো ঝরে ঝরে পড়ছে। এরপর মালি গাছগুলোর নাম দিল ‘ক্রিসমাস ট্রি।’
এই হলো ক্রিসমাস ট্রির গল্প। ছেলেবেলায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা গল্প এটা। আমাদের তারুণ্যে আমরা সকলেই সকলের উৎসবে অংশ নিতাম। বলতাম, ওই ব্যাটা, তোদের না বড়দিন? কি খাওয়াবি বল্। সনাতন ধর্মীয় বন্ধুদের পূজা কিংবা বৌদ্ধ পূর্ণিমা এলেও তাই। আবার আমাদের ঈদের দিনে ওরা আমাদেরকে চেপে ধরত।
আরেকটা গল্প বলি। এইটি একেবারেই বালক বয়সের গল্প।
আমাদের পাড়ায় এক লোক আসত। তার কাঁধে থাকত কাপড়ের একটা পুঁটুলি। পুঁটুলি ভরতি হয়ে থাকত বই দিয়ে। সে এলেই আমরা ছুটে যেতাম। বই দেখতে চাইতাম। লোকটা জানত আমরা কিনব না। ও বয়সি আমাদের কাছে বই কিনবার মতো পয়সা থাকত না। তাছাড়া এখন যেমন হয়, বাচ্চাদের উপযোগী অনেক বই ছাপা হুয়। বই যারা ছাপত তারা সেসময় আমাদের উপযোগী বই ছাপত না প্রায়। ছিল ঠাকুরমার ঝুলি। তখন সকলের বাড়িতেই ও বইটা থাকত। সে বই পড়বার মতো বিদ্যে তখনও আমরা অর্জন করতে পারি নি। বাড়ির বড়রা পড়ে পড়ে শোনাত। তো ও বইঅলার কাছ থেকে আমরা বই কিনব- সে সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। তবু বইয়ের পুঁটুলিটার দিকে থাকত আমাদের বিপুল আগ্রহ। আর সে বইঅলা আমাদের সে আগ্রহকে কখনো অগ্রাহ্য করে নি।
সেবার হলো কি, বইঅলার পুঁটুলির ছাড়াও তার হাতেই ছিল বেশ কিছু বই। আমরা যেসব বই দেখে অভ্যস্ত তেমন নয়, খুব ছোট ছোট। এখন জানি সেগুলোকে পকেট বই বলে। চাইতেই সে আমাদের খুলে দেখাল। তখন অবশ্য বানান করে পড়তে শিখেছি। বইগুলো আমার খুব পছন্দ হলো। চাররঙা প্রচ্ছদ। ভেতরেও নানান ছবি আঁকা। আমি দাম জানতে চাইলাম। লোকটা দাম হাঁকল, এক টাকা। একটু থেমে আবার বলে, এক টাকায় ছয়টা বই।
আমি বিস্ময় নিয়ে লোকটার দিকে চাইলাম। তারপর বললাম, আপনি দাঁড়ান, যেয়েন না। বলে ছুটে আম্মার কাছে। অনেক বায়নার পর এক টাকা জোগাড় হলো।
সে পকেট বইগুলো ছিল যিশু খ্রিস্টের গল্প। এক টাকা লোকটার হাতে দিয়ে বইটা নিতে যেতেই বইঅলা লোকটা আমাকে থামিয়ে দিল, দাঁড়াও। এরপর ভিন্ন একটি বইয়ের সেট আমার হাতে দিয়ে বলে, তুমি এগুলা নাও। আমি সন্দেহ নিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। ভালো বই দেখিয়ে পচা বই দেয় নি তো!
বইঅলাও বুঝল যেন। বলে, তুমি মুসলমান না?
আমি মাথা ঝাঁকালাম, হু।
লোকটা আগের বইগুলো দেখিয়ে বলে, এগুলা খ্রিস্টানদের। তোমারে মুসলমানদেরটা দিছি।
পার্থক্যটা আমি বুঝতে পারি না। চুপ করে তাকিয়ে থাকি। বইঅলা এবারে দু সেট বই ই-মেলে ধরে। পাতা উল্টে উল্টে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখায় প্রচ্ছদ, লেখা, অলংকরণ সবই এক। কোনো পার্থক্য নেই। একটাই পার্থক্য- একটাতে মূল চরিত্রের নাম যিশু, আরটাতে ঈসা।
ধর্ম হলো সমাজ কাঠামোর একটি মৌলিক উপাদান। স্মরণাতীত কাল থেকে এই ধর্ম সমাজের মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ, শান্তি শৃংঙ্খলা আনতে, সমাজের সার্বিক দিকের সকল উন্নতি, অগ্রগতি প্রগতি সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বস্তুত মানুষ যা ধারণ করে তা-ই ধর্ম। মানুষ ভাবনায়, চেতনে, এমনকি অবচেতনেও মনের গভীরে স্রষ্টার অস্তিত্ব ধারণ করে। আর সেকারণেই স্রষ্টাকে তুষ্ট করতে নানান কর্মকাণ্ড করে থাকে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তিতে বিশ্বাস এবং সেই শক্তিকে তুষ্ট করার প্রচেষ্টাটাই হলো ধর্ম।
বস্তুত যিশু ও ঈসা একই ব্যক্তি। এবং একইসঙ্গে ওই ব্যক্তিটি দুটা ধর্মের খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। সেকারণে মানুষটা একই হলেও আমরা দু ভাগে বিভক্ত হয়ে তাঁর আলাদা আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি। কিন্তু তিনি যে কাজ করে গেছেন, নিজের জায়গা থেকেই করে গেছেন। আমাদের আজকের ভেদাভেদ সম্পর্কে তিনি মাথা ঘামান নি। নইলে বইয়ের প্রচ্ছদ যেমন একইরকম, ভেতরের গল্পও তো তাই। আমাদের শিশুমন তো ওই দেখে। কিন্তু আমরা বড় হতে হতে আমাদের ভেতরে বইঅলার মতো করে ভেদ ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
কথা হলো, ধর্ম যেহেতু রয়েছে ভেদও থাকবেই। কিন্তু সে ভেদকে ধর্মেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ভেদকে মানুষের ভেতরে ঢুকতে দেয়া যাবে না। কেননা পৃথিবীর সকল ধর্মই মানবিকতার কথা বলে।
যেমন, ইসলাম বলছে, শান্তি, সৌহার্দ্য, সাম্য-মৈত্রী, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, উদার-নৈতিকতা, মূল্যবোধগত উৎকর্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবিকতা হলো ইসলামের পরমাদর্শ।
আবার সনাতন ধর্মের বেদ বলছে, ধর্মো: হি তেষামধিকো বিশেষো ধর্মেন- এই বাক্যের অর্থে বলা আছে, আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন- এই চারটি কর্ম মানুষ ও পশুর মধ্যে সমানভাবে বর্তমান। মানে হলো প্রেম-ভালবাসা-মানবিকতা যার ভেতর নেই, পশুর সঙ্গে তার কোনো পার্থক্যও নেই।
মোট কথা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- সকল ধর্মই মানবিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। অথচ আজ দেশে দেশে মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে।
এই কাজটি করছে ধর্মকে ব্যবহার করে যারা সুবিধা পেতে চায়- তারাই। আর এই কাজটি তাদের করতে পারার কারণ হলো, আমরা এদেরকে গোকুলে বাড়তে দিয়েছি। কিন্তু সত্যিটা হলো আমরা আসলে বাড়তে দিই নি। বাড়তে দিয়েছে আমাদের অজ্ঞতা। আমরা অজ্ঞ বলেই জানি না, ধর্ম মানব হত্যা তো দূর, কোনো কিছুরই ক্ষতি করবার কোনো অধিকার কাউকে দেয় নি।
আসুন মানবিক হই। কেননা ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ মানবিক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা মানবিক হতে না পারলে পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আমার, আপনার কিংবা কারোর কোনো অধিকার নেই ঈশ্বরের অপূর্ব এই সৃষ্টিকে ধ্বংস করে ফেলবার।
প্রকাশকাল: রূপসী বাংলা, ২৫ ডিসেম্বর ২০২১।