‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পারি’- আবদুল গাফফার চৌধুরী এ কবিতাটি লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকার একটা ঘরে বসে। একুশে ফেব্রুয়ারির রাতেই। ১৯৫২ সালে। আলো ছিল না বলে হারিকেন জ্বালাতে হয়েছিল। কিন্তু ভয় ছিল। ছিল নিরাপত্তাহীনতা। আলো টের পেলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যেতে পারে। আলো আড়াল করতে হারিকেনটাতে কাপড়জামা চাপানো হয়েছিল। ও ঘরটা ছিল শফিক রেহমানের। বেইলি রোডের যায়যায়দিন অফিসে বসে শফিক রেহমানই গল্পটা করেছিলেন একদিন। ওইদিন ভাষার দাবিতে করা তরুণদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার আর শফিউর শহীদ হয়েছিলেন সেদিন।
এখন তো ফেব্রুয়ারি মাস। বাঙালির গর্ব আর অহংকারের মহান ২১শে ফেব্রুয়ারির মাস। বাঙালির কাছে ফেব্রুয়ারি মাসটি তার নাম ছাপিয়ে ভাষার মাস নাম নিয়ে পরিচিতি অর্জন করেছে- সেও সত্তর বছর হতে চলল। আর এখন ও পরিচিতি কেবলমাত্র বাঙালির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আর্ন্তজাতিক পরিচিতি অর্জন করছে। ফেব্রুয়ারি এখনও ভাষা দিবস বটে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে আন্দোলন করতে হয়, মিছিল করতে হয়, তারপর সে মিছিলে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলা হয়- এমন ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। নেই আসলে। নেই বলেই যারা বাংলা ভাষা আন্দোলনের খবরটি জানেন না, তারা শুনেই হা করা বিস্ময় জানিয়ে দেন। ইতিহাসটা জানবার পর তাদের চোয়াল ঝুলে পড়ে। তখন খুব হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন।
এই হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়বার অর্থ হলো, তারা আসলে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারেন না যে, কাউকে মাতৃভাষায় কথা বলতে দিতে কেউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। তাদের সে বিস্ময় তখন সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন তারা জানতে পারেন নিষেধাজ্ঞার এই আরোপ দেশটির রাষ্ট্র পরিচালকরা করেছিল।
‘ভাষা’ ব্যাপারটা তো কেবল কতগুলো বর্ণ, শব্দ আর বাক্যের সমষ্টি নয়। ভাষা মানুষের সত্ত্বা। প্রাণ মানুষের। ভাষাই একমাত্র উপাদান যেটি মানুষকে মানুষের কাছে মানুষ করে উপস্থাপন করতে পারে। ভাষা কেবল মনের ভাব ফুটিয়ে তোলে না, মানুষের পরিচয়টি উঁচুতে তুলে ধরে। জন্মের পর সকলের আগে যেটি মানুষ শিখতে শুরু করে, সেটি ভাষা। সেই শেখার কোনো বিরাম নেই। চলতেই থাকে। আমৃত্যু আপনাপন শব্দভাণ্ডারে জমা হতে থাকে নতুন নতুন শব্দ। এবং শব্দভাণ্ডারে এই জমা করতে থাকা সেসব শব্দ মানুষ খুব করে স্মরণ করতে চেয়ে খুব সচেতনতায় স্মৃতিতে রেখে দেয়, তা কিন্তু নয়। নিজে থেকেই জমতে থাকে। দরকারি থেকে অদরকারি- সকল ধরনের শব্দই। এই-ই মাতৃভাষা। আর মাতৃভাষা বলেই ও ভাষা নিজেই এমন স্বতঃস্ফূর্ত। উচ্চারণমাত্র বোধনে মিশে গিয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে।
মাতৃভাষায় কথা বলতে বাধা দেয়ার অর্থটা হলো- মানুষটা হাঁটবে, চলবে, খাবে, ঘুমাবে, কাজে যাবে ঠিকই, কিন্তু সে আর মানুষ থাকবে না। সে তখন যন্ত্রবিশেষ। অন্য লোকের ভাষায় প্রয়োজনটা মেটানো যায়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা যায় না। প্রবাসীরা এটি খুব জানেন। তো এই প্রক্রিয়াটির উদ্দেশ্যটা হলো মানুষটার অনুভূতিগুলোকে মেরে ফেলবার আয়োজন। আর মানুষের যদি মানবিক অনুভূতি না থাকে, তবে সে আর মানুষ থাকে? থাকে না তো। ভেতরের মানুষটা মরে যায়। বেঁচে থাকে বটে, কিন্তু সে বেঁচে থাকায় কেবল প্রাণটা থাকে। জীবন থাকে না। তারমানে মাতৃভাষায় কথা বলতে না দেয়াটা আসলে খুব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিকে শুরু থেকেই মেরে ফেলবার আয়োজনে খুব পরিকল্পিতভাবেই ষড়যন্ত্র নির্মাণে মনোনিবেশ করেছিল। নইলে মানুষ কোন্ ভাষায় কথা বলবে- সেটি নির্ধারণ করে দেবার মতো স্পর্ধিত অথচ স্থূল সিদ্ধান্ত নেবার পক্ষে সঙ্গত কোনো কারণ ভাসমান নয় কখনো।
১৯৯৮ সালে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম যখন একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন, প্রস্তাবে তাঁরা বললেন, বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেটা ছিল তাদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। কাজেই মাতৃভাষা দিবসের দাবিটি খুবই ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু ইউনেস্কো কিছু বলে-টলে না। বছর পেরিয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা আন্না মারিয়া একটি চিঠিতে রফিকুল ইসলামকে বললেন, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার তোমাদের অনুরোধটি বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়েছে।
আন্না মারিয়ার এই আকর্ষণটি আসলে নতুনত্ব। কাউকে যে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে চেয়ে আন্দোলন করা লাগতে পারে- এটি আন্না মারিয়ার ভাবনার ঝুলিতে ছিল না কখনো। আন্না মারিয়ার ভাবতে পারেন নি কখনো। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় রক্ত দিয়ে লেখা সে গল্পটি আন্না আর ইউনেস্কোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব, চর্চা ও মূল্যায়ন নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হওয়া জ্বলজ্বলে গল্পটি তাদেরকে মাতৃভাষার গুরুত্ব, চর্চা ও মূল্যায়নের চর্চাটিকে দরকারি মনে করালো।
একুশেকে যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত হলো তখন ইউরোপের দেশগুলো সমস্যা তৈরি করল। দিবস ঘোষণায় তাদের আপত্তি নেই। তাদের আপত্তির জায়গাটি হলো তারিখ- একুশে ফেব্রুয়ারি। তখন তাদেরকে জানানো হলো, পৃথিবীতে বাঙালিরা মাতৃভাষার অধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছে। সেটা ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখে। এটা শুনে তারা চুপ করে গেল। আপন মাতৃভাষায় কথা বলতে চায় বলে গুলি করে মেরে ফেলা যায়, এটি ইউরোপের লোকেদেরও ভাবনার বাইরে।
ভাষা কেবল মানুষের অধিকার নয়, ভাষা মানুষের অস্তিত্ব। আর অস্তিত্বটা হলো আপাদমস্তক মানুষটা নিজেই। ভিন্ন ভাষায় প্রয়োজনটা মেটানো যায়, কিন্তু আকাঙ্ক্ষা আর অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করা যায় না। তাতে অনুভূতিগুলো একটু একটু করে মরে যেতে থাকে। অনুভূতিগুলো মরে গেলে ভেতরের মানুষটাও মরে যায় তখন। শরীরটা বেঁচে থাকে বটে, কিন্তু সে বেঁচে থাকায় কেবল প্রাণটা থাকে। জীবন থাকে না। মাতৃভাষায় কথা বলতে না দেয়াটা আসলে খুব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিকে খুব পরিকল্পনা করেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল। ষড়যন্ত্রের শুরুটা বাংলা ভাষাকে হত্যা দিয়ে। পরে সরাসরি হয়েছে। ’৭১-এর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট থেকে শুরু করে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা পর্যন্ত সকল হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাটিতে বাঙালিকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না দেয়ার ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রকে সফল রূপায়নে পাকিস্তানিরা তিরিশ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলল। দু লক্ষের বেশি নারীকে ধর্ষণ করল।
তবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখন নেই। পরাজিত হয়ে বাংলা ছেড়েছে। ভাষা এখন স্বাধীন।‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান তুলে মিছিল করবার অপরাধে যে ছেলেগুলোকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল বলে পুরো জাতি ফুঁসে উঠেছিল, সে দেশটা এখন স্বাধীন হয়েছে। রাষ্ট্রের ভাষাটিও বাংলা হয়েছে। কিন্তু জাতির রুচি গেছে বদলে। এ জাতির লোকেরা এখন বাংলায় লেখাপড়া করাকে পশ্চাদপসরণ মনে করে। রাষ্ট্র পরিচালকরাও এমন ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছেন যে, সে ব্যবস্থার ফলে সকলে দলবেঁধে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার দিকে প্রাণপণে ধাবিত। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে রায় থেকে সকল কার্যক্রম নাকি ইংরেজিতেই পরিচালিত হয়। এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, দেশটিতে এখন বিনোদনের প্রধান মাধ্যমটির ভাষাটি হলো হিন্দি। আবালবৃদ্ধবনিতা কখনো কারো কাছে হিন্দি না শিখেও দিব্যি হিন্দি জেনে যান।
আর স্রোতহীন নদীনালা খালবিল নর্দমার নোংরা জলেতে বাংলা ভাষা ভাসতে ভাসতে চলেছে। আপন গতিতে নয়; নর্দমার নোংরা জলের স্রোতের গতিতে।
প্রকাশকাল: দেশকণ্ঠ / রূপসী বাংলা, ২০২০।