পয়লা বৈশাখ এলেই একটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যান। তারা পয়লা বৈশাখ উদযাপনের বিরোধিতা করেন। বিরোধিতা করবার পক্ষে তাদের যুক্তিটি থাকে ধর্মীয়। তারা বলেন, ইসলাম ধর্ম পয়লা বৈশাখ উদযাপনকে স্বীকৃতি দেয় না। এ নিয়ে তর্ক করতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। বিতর্ক ভালো লাগে না। তারচেয়ে তথ্য বলি।
আমরা সকলেই জানি, আরবি হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি ঘটেছিল। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বাংলার কৃষকদের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়েছিল। সেসময় এর নাম দেয়া হয়েছিল ফসলী সন। পরে সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে এর পরিচিতি হয়ে ওঠে বাংলা সন। মুঘল শাসনামলে এ দেশে বছর গণনা হতো হিজরি সনের ভিত্তিতে। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে হিজরি বছরের মিল হতো না। এর ফলে কৃষকদের ফসলী সন গণনায় সমস্যা হতো। এর ফলে কৃষক থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দিল। কৃষক ও জমিদারের সমস্যা সমাধান করতে আর জমির খাজনা আদায়ে সুবিধা পেতেই বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়। যার ফলে বাংলা নববর্ষ বাঙালির উৎসব বটে, কিন্তু আমেজটা কৃষকের ক্ষেত্রে একটু বেশি।
তবে একই সঙ্গে বাংলা সন প্রবর্তনের কারণে মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মেই একটা প্রভাব পড়ল। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে প্রবর্তিত হয়েছিল বটে, তবে বাংলা সন এসে একই সঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তাকে একটা মিলিত স্রোতে টেনে নিয়ে অসা¤প্রদায়িক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিল। বাঙালির সংস্কৃতিকে দাঁড় করিয়ে দিল এক ভিন্ন উচ্চতায়। উৎসবটা ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে এসে হয়ে উঠল সকলের, সর্বজনীন। হয়ে উঠল বাঙালির সংস্কৃতি- আমাদের পরিচয়। সংস্কৃতির ধারক হয়ে বাংলা সন মিশে গেল বাঙালির অস্তিত্বে। আর বাংলা নতুন বছরের সূচনার দিনটিই পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণই একমাত্র উৎসব যার সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগাযোগ নেই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালির একমাত্র উৎসব পয়লা বৈশাখ।
এখন বাংলা নতুন বছরের এই দিনটি বাঙালির জাতীয় জীবনে অসা¤প্রদায়িক আর সর্বজনীন প্রধানতম এক উৎসব। বাঙালি মাত্রই পয়লা বৈশাখে বরণ করে নেয় নতুন বছরটিকে। আর এই বরণকে কেন্দ্র করে সে নির্মাণ করে এক আনন্দদায়ক পরিবেশ। নিজের অজান্তেই গেয়ে ওঠে, ‘তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, / বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক…’
বাঙালির জীবনে উৎসব আসে বসন্ত আমেজে। আসে ফুরফুরে বাতাসের মতো। সে আনন্দঘন পরিবেশ নির্মাণ করে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। জীর্ণ-শীর্ণ পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনের আহŸানে সাড়া দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। বাঙালির এই চিরায়ত উৎসবে মেতে ওঠা, প্রাণ খুলে আনন্দে ভেসে যাওয়া, অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির কামনার উদযাপনে সাজানো হয় পয়লা বৈশাখ।
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের পরিবেশটি তাই উৎসবমুখর। শিশু-তরুণ-যুবক থেকে বৃদ্ধ- সকল বয়সের, সকল শ্রেণি ও মানুষ উদযাপন করে দিনটি। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের দিনটি পয়লা বৈশাখ বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। আর উৎসবে প্রধান অনুষঙ্গটি বৈশাখী মেলা। আগে গাঁয়ে গাঁয়ে আমানি, রাজপুণ্যাহ, হালখাতা, গাজনের গান চলত মাস জুড়ে। এখনও চলে হয়ত, কিন্তু নিশ্চিত জানি সেভাবে নয় একদম। মাস জুড়ে তো নয়ই। বাংলা সন প্রবর্তন থেকেই সাধারণ মানুষের সাথে এর পরিচয় সুগভীর। আপনি যদি গ্রামের কোনো সাধারণ লোকের কাছে জানতে চান, আজ বাংলা মাসের কত তারিখ? তিনি হাতের আঙুলের কড় গুণে বলে দেবেন। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা সনের পরের গুরুত্বটি হচ্ছে হিজরি সনের। বাংলা সন প্রবর্তনের বছর থেকেই জমির খাজনা পরিশোধ করা হচ্ছে। এ নিয়মই আজ পর্যন্ত বিদ্যমান।
ইংরেজ শাসনামল অবসানের পর কালক্রমে ‘নববর্ষ’ উদযাপন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তীকালের ঘটনা বাংলা ‘নববর্ষ’ উদযাপনকে প্রাণবন্ত ও বিস্তৃত করেছে। অবশ্যই সা¤প্রতিককালের ‘নববর্ষ’ বা ‘বর্ষবরণ’ ও আগের দিনের ‘নববর্ষ’ বা বর্ষবরণের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বেড়েছে চাকচিক্য কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন কমেছে আন্তরিকতা। যদিও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যে ‘নববর্ষ’ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ ভাজার মুখরোচক আহারবিলাস পাওয়া না গেলেও এর সমারোহ ঘটানো হয়েছে। তবে এই সমারোহে নেই প্রাণের ছোঁয়া। এ কেবলই ধনী ও বিলাসী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা। অসহায় আর দরিদ্র মানুষদের এতে কোনো আয়ব্যয় নেই। এ শুধুই আধুনিক শহুরে মানুষদের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের আয়োজন।
নানান তথ্য উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, পান্তা-ইলিশের সূচনাটি হয়েছে খুবই সা¤প্রতিক। রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসব চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। সেসময় কারো ব্যবসা বুদ্ধিতে রমনায় বসে পান্তা-ইলিশের ভাবনাটি এল। দেখা গেল, এই ব্যবসা বুদ্ধি খুব কাজের। শহুরে বিত্তবানেরা রাতারাতি বাঙালী বনে যাওয়ার লোভে লুফে নিল একে। এরপর ব্যবসাটি জায়গা করে নিল সংস্কৃতিতে। এখন পয়লা বৈশাখ এলে বাড়িতেও পান্তা-ইলিশের বৈশাখী আয়োজন চলতে শুরু করে দিয়েছে।
আবহমানকাল থেকেই পয়লা বৈশাখ বাঙালি উদযাপন করে আসছে মেলা। মূল আয়োজন হালখাতার সঙ্গে থাকত আরো নানান অনুষঙ্গ। থাকত ঘরে ঘরে ভালো খাবারের আয়োজন। তবে পান্তা কিংবা ইলিশ কখনোই পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ ছিল না। এর প্রচলন আশির দশকের শেষের দিকে। কিন্তু কি করে যেন খুব তাড়াতাড়িই পান্তা-ইলিশ পয়লা বৈশাখের সমার্থক হয়ে উঠল। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছিল বাঙালি কৃষকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্র করে, বাংলা নববর্ষের মূল উৎস যে কৃষক ও কৃষি- এই সত্যটিই আজ বাঙালি বিস্মৃত।
বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই একটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে। এই আগ্রাসন বর্তমান প্রজন্মকে এক ধরনের বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে তাদের ভেতর জাতীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার চেতনার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাঙালির জন্যে বাঙালি সংস্কৃতির যে কোনো বিকল্প নেইÑ এই বোধাটির বড় অভাব। এই বোধটি তাদের মধ্যে জাগ্রত করা খুব জরুরি। বাহ্যিক চাকচিক্যময় কুরুচিপূর্ণ আগ্রাসী অপসংস্কৃতি আমাদের যুব ও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে ভিনদেশী সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে তারা। এই অপসংস্কৃতিকে প্রতিহত করতে না পারলে বাঙালি কালের অতলে তলিয়ে যাবে। সেকারণে অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরা ছেড়ে ভিন্ন কোনো উপায় নেই। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ নামক ভ‚খÐটির বয়স পঞ্চাশ বছর হলেও বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের। আর জাতির ইতিহাস এত এত প্রাচীন যে, তার সংস্কৃতি ভীষণভাবেই সমৃদ্ধ। বাঙালি সংস্কৃতি মানবিক ও সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির সংস্কৃতি। পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতিকে পরিহার করে মানবিক ও সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকে প্রতিষ্ঠা করবার বার্তাই বছর বছর নিয়ে হাজির হয় পয়লা বৈশাখ।