ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ কলিংউড বলেছিলেন, ইতিহাস লিখবেন একজন পেশাদার ইতিহাসবিদ। আর সেটা লিখবেন ঘটনা ঘটে যাওয়ার দুটি প্রজন্ম পরে। তারমানে কম করে হলেও পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলে। কেননা তখন ইতিহাসকে প্রভাবিত করার মতো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সক্রিয় থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সময় থেকে গুনলে এখন কিছুটা বাকি। যদিও ইতিহাসকে প্রভাবিত করার মতো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে এখনও।
একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরে নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরিতে যেতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর শহীদ মিনারে যাওয়ার সে ছবি দেখলে বারবার মন বলতে থাকে, আমাদের জন্যে এই মানুষটির বেঁচে থাকার খুব দরকার ছিল। সেসময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে ছিলেন বলে নির্মম ওই হত্যাযজ্ঞ বেঁচে গেছেন। নইলে ঘাতকরা বাকি সবাইকে যেভাবে হত্যা করেছিল, তাদেরকেও সেভাবেই হত্যা করত। এমন নারকীয় হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পুরো বাংলাদেশ জুড়ে মুখরিত ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম। সেদিন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কুচক্রীরা এ নামটি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
সেদিন খুনিরা শুধু বঙ্গবন্ধু বা তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীরা নন, খুন হয়েছিলেন নারী-শিশুসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে সেদিন একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। পরিবারের কাউকে জীবিত রাখে নি তথাকথিত বিপ্লবী বা অভ্যুত্থানকারীরা। বাংলাদেশে তখন সহিংসতার মাত্রা এত ছিল যে হত্যাকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য জারি করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন, দলে এত নেতা, তারপরও তাঁর বাবার লাশ বত্রিশ নম্বরে পড়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
পঁচাত্তরের সেই ১৫ আগস্টের শ্রাবণের রাতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের অশ্রু যেন এক হয়েছিল। আসলে তো শুধু তো বঙ্গবন্ধু নন, তার আদর্শকেই হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। সেকারণেই বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সব সদস্য তো বটেই, এমনকি নারী বা শিশু রাসেলও বাদ যায় নি।
১৫ আগস্টের সেই কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল ও সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক।
প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত ও এক আত্মীয় আবদুর নঈম খান রিন্টুকে হত্যা করে।
প্রশ্ন উঠতে পারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কী? আমি বলব, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানে তার দেশ্রপ্রেম, তার অপোসহীনতা, তার সততা, সবসময় মানুষের কথা ভাবা, মানুষের জন্যে তাঁর অসীম ভালোবাসা। একটা মানুষ দেশকে কী পরিমাণ ভালোবাসলে বলতে পারেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি।’
একবার এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি তো সসময়েই এই এই স্লোগান (জয় বাংলা) উচ্চারণ করি। আমি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময়কলেমা উচ্চারণের সঙ্গে এই স্লোগানও (জয় বাংলা) বলব”।
ঠিক এই কারণের সঙ্গে আরও অসংখ্য কারণ জড়িয়ে আছে বলেই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এদেশের একদল মানুষ বুকের মধ্যে সযত্নে বঙ্গবন্ধুকে বুকের গহীনে লালন করেছেন। সেজন্যেই বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তিনি আসলে বেঁচেই আছেন। বেঁচে আছেন লক্ষ-কোটি বাঙালীর হৃদয়ে। আজ শোকের দিনে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধু ও সেদিন ‘৭৫-এর পনের আগস্টে যারা নিহত হয়েছিলেন- তাঁদেরকে সকলকে। আমাদের এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধুও থাকবেন। থাকবেন যে সেকথা তো বাঙালী কবি ও প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেই রেখে গেছেন— যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।