‘জ্যামিতি পড়ানোর সময় একটা জিনিস আমাদের কখনোই শেখানো হয় নি আর সেটা হচ্ছে সময় । চতুর্থ মাত্রা!’
‘কিন্তু আপনি আশা করি বুঝতে পারছেন কেন ওরা সময়কে হিসাবে ধরেনি,’ ব্যাখ্যা করলেন পেরি। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা আসলে স্থান পরিমাপের মাত্রা। আপনি ওগুলোতে সামনে-পিছনে যেতে পারবেন। সময় পরিবর্তন সম্ভব নয় ।’
‘ভুল! ভুল বলছেন আপনারা!’ বলে উঠলেন সময়-যাত্রী । ‘আসলে আমরা সেটা করতে পারি।’
‘তুমি কী বলতে চাইছ?’ উঠে দাঁড়িয়েছেন ফিলবি। ‘আমি এই ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলাম । আমি একটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে পারি বা উঠতে পারি কোনো বেলুনে। আমি চারপাশের স্থানে চলাচল করতে পারি কিন্তু আমি গতকাল বা আগামীকালে চলে যেতে পারি না।’
‘সেটা তুমি ভাবতেই পার,’ শান্তভাবে বললেন সময়-যাত্রী। ‘আমি এ ব্যাপারে অনেক বছর ধরে পরীক্ষা করছি। এবং আমি একটা যন্ত্র উদ্ভাবন করেছি যা আমাদের অতীত বা ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে পারে।’
টেবিলের চারপাশে সবাই হেসে উঠল । ‘অসম্ভব!’
ওপরের গল্পটি বিশ্ব বিখ্যাত ইংরেজ লেখক এইচ. জি. ওয়েলসের ‘দ্য টাইম মেশিন’ উপন্যাসের অংশ। বইটি প্রকাশ হয়েছিল আজ থেকে ১২৮ বছর আগে, ১৮৯৫ সালে। এইচ. জি. ওয়েলসই টাইম ট্রাভেল নিয়ে ভেবেছিলেন, গল্পও লিখে ফেলেছিলেন। তখনও আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ হয় নি। আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন যথাক্রমে ১৯০৫ এবং ১৯১৫ সালে। থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রকাশ হওয়ার পরই বিজ্ঞান জোরেশোরে সময় নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
অথচ দেখুন একজন লেখক তার আগে থেকেই টাইম মেশিন বানিয়ে অতীত ঘুরে আসছেন, চলে যাচ্ছেন হাজার হাজার বছর ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। তারপর আবার ফিরে আসছেন নিজের জগতের বর্তমানে। আইনস্টাইন বলেছেন, কল্পনাই সব। কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও শক্তিশালী।
লেখক এই কল্পনা নিয়েই করেন। লেখক হলেন শিল্পী, ভাষা শিল্পী তিনি। অক্ষরের সঙ্গে অক্ষর জুড়ে দিয়ে লেখক নির্মাণ করেন ভিন্ন এক জগত। আপনা ভাষা শৈলীর দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে লিখে চলেন উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক, চিত্রনাট্য এবং প্রবন্ধ আর খবর নিবন্ধ। এবং লেখকের এসব সৃষ্টিশীল লেখাগুলোকে যিনি মানুষের সামনে মেলে ধরে উপস্থাপন করেন- তিনি প্রকাশক। সেকারণেই লেখক ও প্রকাশককে বলা হয় একে অপরের পরিপূরক। প্রকৃষ্ট খুঁজে নিয়ে সাহিত্যকর্ম পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া একজন মেধাবী ও দায়িত্বশীল প্রকাশকের কাজ।
লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মেলবন্ধন ঘটে যেখানে সেটি বইমেলা। বইমেলার শুরুটা বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা দিয়ে শুরু হলেও বইমেলার ধারণাটির শেকড় আজ অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে ডালপালা মেলেছে বহুদূর।
বাংলা বইয়ের সম্ভার নিয়ে চলে গেছে দেশের সীমা পেরিয়ে বিদেশেএ। যদিও বাংলা একাডেমির তুলনায় সেসবের পরিসর অনেক ছোট। আবহ অনেক অন্যরমক। সময়ের মাপেও ছোট অনেক। কিন্তু বিদেশের মাটিতে সদ্য নতুন বাংলা বইয়ের সেই গন্ধ তো ঠিক তেমনই আছে। আছেন প্রবাসে বাস করা বাঙালী পাঠক, আছেন লেখক, আছেন প্রকাশকও। দেশের মতো বিদেশের বইমেলাতেও চলে নতুন বইয়ের পাতা মোড়ক খুলে পাতা ওলটানো, গন্ধ নেওয়া, চলে আড্ডা, বক্তৃতা আর কবিতা পাঠ। চলে আরও অনেক কিছুই। কিন্তু মুখ্য তো বই। উপস্থিত লেখককে পাঠক বইটি এগিয়ে দেন, লেখক হাসিমুখে লিখে দেন শুভেচ্ছা বাণী। এ এক ভিন্নরকম আনন্দ। আমরা আবারও নতুন করে উপলব্ধি করি- বইয়ের সান্নিধ্য সত্যিই অতৃপ্ত আত্মাকে দেয় পরিতৃপ্তি।
দেশ বিদেশ কথা নয়, কথা হলো বাংলা বই নিয়ে বইমেলার মতো এই দারুণ এআয়োজন টিকে থাকুক পৃথিবীর সকল বাঙালী আর বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে।