নারায়ণগঞ্জ: অহমিকা নয়, গৌরবের

0 comment 84 views

নারায়ণগঞ্জ জেলার খুব বিখ্যাত একটি জায়গার নাম সোনারগাঁ। সোনারগাঁ কেবল একটি জায়গা নয়। নয় শুধুই একটি নাম। সোনারগাঁ হলো প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত জনপদ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ধারণ করে আছে সোনারগাঁ। এই ভূখণ্ডের প্রাচীনতম রাজধানীটিই হলো সোনারগাঁ। মধ্যযুগে সোনারগাঁ মুসলিম সুলতানদের রাজধানী ছিল। ধারণা করা হয়, ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে এ অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্যের সূচনা হয়।

সোনারগাঁ এখন লোকশিল্প জাদুঘর। ওর  বিখ্যাত হয়ে ওঠা কিংবা পরিচিতির ব্যাপ্তিটাও লোকশিল্প জাদুঘরকে কেন্দ্র করেই। আমরা যে খুব দারুণ অহংকার আর গর্ব ভরে গ্রীবা উঁচু করে করে মসলিন কাপড়ের গল্প বলি, এই মসলিন কাপড় উৎপাদিত হতো এই সোনারগাঁয়েই। ভীষণ সূক্ষ্ণ সুতা দিয়ে তৈরি করা হতো মসলিন। বলা হয়ে থাকে মসলিনের তৈরি বড় মাপের একটি চাদর এখনকার এক টাকা দামের ছোট দেশলাইয়ের বাক্সে ঢুকিয়ে রাখা যেত। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে মসলিন কাপড় রক্ষিত আছে দেখেছিলাম। এই মসলিন কাপড়টির দৈর্ঘ্য ১০ গজ আর প্রস্থ ১ গজ। এর ওজন ওজন উল্লেখ করা আছে ৭ তোলা। মেট্রিক পদ্ধতি চালু হয়েছে বহু আগেই। সে কারণে এখন তোলা হিসেবটা হয়ত এখন অনেকেই বুঝবেন না। প্রায় সাড়ে এগারো গ্রাম ওজনে হয় এক তোলা। তারমানে জাদুঘরে রক্ষিত তিন ফুট চওড়া আর তিরিশ ফুট লম্বা মসলিনটির ওজন ৮২ গ্রাম থেকেও কম!

অবশ্য মসলিনটি দেশলাই বাক্সে ঢুকিয়ে রাখা নেই। শাড়ির মতো করে ভাঁজ করে কাঁচ দিয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা আছে। ছুঁয়ে দেখবার জো নেই। ছোঁবার অনুমতিও নেই। ছুঁয়ে দেয়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো সে নিষেধাজ্ঞা মানতে চায় না। নিষেধাজ্ঞা ভাঙতে চায়। দারুণ দুর্বার এক আকর্ষণে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ফেলে সে দেখতে চায় অভ্যন্তরের রহস্য। ওটি অবশ্য হাজার বছরের পুরনো নয়। কিন্তু সকল সীমা ভাঙতে নেই। সকল জানতেও নেই। জানতে গেলেই শত শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাকে রক্ষা করতেই কাঁচ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।

মসলিন আমাদের আজকের আলোচ্য নয়। আমরা সোনারগাঁ সম্পর্কে বলতে চাই। যে কোনো বিষয়ে জানবার সবচেয়ে সহজ মাধ্যমটি হলো খোলামেলা আলোচনা। আপনি আপনার জানার পরিধি জানাবেন, আমরা বলব আমাদেরটা। তারপর ওর থেকে অতিরঞ্জিতটুকু ফেলে দিয়ে ছেঁকে তুলে নেব বাস্তবতাটুকু।

ইতিহাস বই আমাদেরকে জানাচ্ছে, নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার দুরত্বে গড়ে ওঠা সোনার তৈরি গ্রাম নাম নিয়ে সোনারগাঁ যখন শহর হয়ে গড়ে ওঠে, আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা তখন সত্যিকারের গাঁ। অথচ দেখুন, এইত সেদিন, ২০০৮ সালে আমরা ঢাকা শহরটির চারশ’ বছর উদযাপন করলাম। মজার ব্যাপার হলো ঢাকা যখন শহর হলো তখনও কোলকাতা গ্রাম। ১৬০৮ সালে ঢাকাকে সুবে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করা হয়। সেসময় দিল্লির সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব। এই ঘোষণার বহু আগে থেকেই সোনারগাঁ ছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানী। আমরা জানতে পারি, এই সময়টি ছিল ঈশা খাঁ আর তার বংশধরদের শাসনামল।

সোনারগাঁর আরেকটি নাম পানাম। জানেন, এই নামটি আমার ভেতরে অনেকগুলো দিন একটা বিভ্রান্তি তৈরি করে রেখেছিল। আমরা ভাবতাম সোনারগাঁ আর পানাম নগর দুটা স্বতন্ত্র জায়গা। এর অবশ্য কারণও আছে। নগর মানে তো ছোট শহর। তার পরিসর শহরের তুলনায় সীমিত। নগর হলো গাঁয়ের পরবর্তী সংস্করণ। ওর মধ্যে থাকলে সুযোগ সুবিধাগুলো গ্রামীণ পরিবেশের চেয়ে একটু বেশি, আবার শহরের থেকে কম। যেমন ধরুন, নিউ ইয়র্ক আর নিউ জার্সি। উপমাটা ঠিক বললাম কি? কি জানি!

পানাম নগরের বেশকিছু ভবন আছে। গোনবার অসুবিধা থেকে রক্ষা পেতে সবগুলো ভবনের দোরের ওপরে ইংরেজিতে নম্বর সেঁটে দেয়া হয়েছে। মোট বায়ান্নটা ভবন আছে সেখানে। ভবনগুলো তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট লাল ইট দিয়ে। রাস্তার দু পাশে লাল রঙা ভবন আর তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে মসৃণ পাকা করা পিচঢালা পথ। কি যে সুন্দর দেখতে!

ইতিহাসের বই ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা গেল, ধারণা করা হয় তেরো শতকের শেষ সময়টা পর্যন্ত হিন্দু আমলের রাজধানী ছিল। এরপর মুসলমান শাসকরা এলে পুর্ববঙ্গের প্রাদেশিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল সোনারগাঁ। অনেকে মনে করেন,  সোনারগাঁ নামটি এসেছে প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম থেকে। আবার কেউ কেউ বারো ভূঁইয়া প্রধান ঈশা খাঁ’র স্ত্রী সোনাবিবির নাম থেকে সোনারগাঁ নামটি রাখা হয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদগুলোর মধ্যে শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সোনারগাঁও একটি গৌরবময় জনপদ- এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই বটে।

পানাম শহরের ঠাকুরবাড়ি ভবন আর ঈশা খাঁ’র তোরণ নিয়ে মোট প্রায় ষোল হেক্টর জমি জুড়ে লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে একটা জাদুঘর, লোকজ মঞ্চ, সেমিনার কক্ষ আর কারুশিল্প গ্রাম। জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে প্রায় সাড়ে চারহাজার নিদর্শন। এবং এই অসাধারণ কাজটি করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়।

সোনারগাঁ  এখন উপজেলা। এই উপজেলার বারদী বাজারের পশ্চিম-উত্তর কোণে রয়েছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম। বারদীর এই লোকনাথ আশ্রমটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থান। এবং একইসঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ- নির্বিশেষে সকল ধর্মের সকল মানুষের কাছেই এক মিলন মেলা হিসেবে পরিচিত অর্জন করেছে। তাকে নিয়ে বহু জনশ্রুতি আছে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন হিন্দু যোগী সন্ন্যাসী ও আধ্যাত্মিক গুরু। অর্জিত তপস্যা শক্তিবলে মানুষের হিত সাধন করতেন তিনি। তাঁকে স্বয়ং মহাদেবের অবতার বলে মনে করা হয়। পুঁথি বিদ্যায় আগ্রহ না থাকায় মাত্র এগারো বছর বয়সে কালীঘাটের প্রখ্যাত যোগ-সাধক ভগবান গাঙ্গুলীর কাছে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন। সেসময় কালীঘাট ছিল জঙ্গলে ঘেরা। সেখানে পঁচিশ বছর চারণ সন্ন্যাসী হিসেবে ব্রত পালন শেষে তিনি হিমালয় পর্বতে গিয়ে কঠোর যোগ-সাধনা করেন। হিমালয়ের গভীর অরণ্যে সাধনা চলে বহুকাল। তারপর অর্জিত জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে ফিরে আসেন লোকালয়ে। পরবর্তীতে লোকনাথ ব্রহ্মচারী আফগানিস্তান, পারস্য, মক্কা, মদিনা, প্যালেস্টাইন, চীন ও তিব্বত ঘুরে ১৮৬৩ সালে সোনারগাঁয়ে এসে এখানকার বারদী গ্রামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ১৫০ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি ১৮৯০ সালে মারা যান। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এ হিসেবটি ১২৯৭ সালের ১৯ জৈষ্ঠ। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে  সপ্তাহ ব্যাপী আশ্রমে তিরোধান উৎসব ও সপ্তাহ ব্যাপী মেলা আয়োজিত হয়। আশ্রমের উঠানে লোকনাথ ব্রম্মচারী সমাধিস্থলের পাশেই শতবর্ষী ও খুবই দর্শনীয় বিশাল এক বকুল গাছ। লোকনাথ ব্রহ্মচারী যখন বেঁচে ছিলেন, সেসময় আশ্রমের পাশে কামনা সাগর ও জিয়স নামে পুকুর খনন করা হয়। এই পুকুরে এখন আশ্রমে আগত ভক্তরা স্নান করেন।

‘নারায়ণগঞ্জ’ ম্যাগাজিন, নভেম্বর ২০২১।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing