দেশপ্রেম কেবল ভালোবাসা নয়, দায়ও

0 comment 42 views

একটি তথ্য জানাতে চেয়ে আজকে শুরু করতে চাই- সুপ্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনকের সদস্যবৃন্দ, আপনারা কি জানেন, আপনারা আমার কত বড় অহংকার? বস্তুত আমেরিকায় গড়ে ওঠা সকল বাংলাদেশীদের সকল সংগঠনই আমার বিপুল অহংকার। একেকটি সংগঠন গড়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার মাটিতে বাংলাদেশের একটি একটি করে পতাকা ভীষণ গর্বিত ভঙ্গিতে দেশ থেকে সুদূরে এদেশের হাওয়ায় নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করে।

আমেরিকায় যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ছেলেমেয়েরা মিলে একটা সংগঠন বানিয়ে ফেলেছে আর সে সংগঠনের বয়সটিও শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে পূর্ণ যৌবনে এসে পৌঁছে গেছে- এ খবরটি সম্পর্কে আমি একেবারেই অ-খবর ছিলাম। এখানে একটু সংশোধন দরকার মনে হয়। কেননা যে সংগঠনের বয়স ২৯ বছর, সেখানে ‘ছেলেমেয়েরা মিলে’ কথাটি কেমন যেন লাগে, ঠিক যায় না অর সঙ্গে। এর চেয়ে ‘ছাত্রছাত্রীরা মিলে’ বললে একটি নিরাপদ আবহে দাঁড়িয়ে নিজের কথাগুলো বলতে পারি। তার আগে সাততাড়াতাড়ি অভিনন্দন জানিয়ে রাখতে চাই। চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনক ও এর সঙ্গে জড়িত সকলকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন।

আসলে ‘ছেলেমেয়েরা’ বলবার পক্ষে যুক্তি রয়েছে। তবে সে যুক্তিও আমার একলার নয়। এবারে যদি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনকের বয়স ২৯ বছর হয় তাহলে এইটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। আমার জন্যে সময়টি তারুণ্যের ঘোরকাল। ফলে ও সময়ের যা কিছু, সকলই বড় আপন লাগে। এই যে দেখুন না, আজকে যে এখানে এই লেখাটি লিখছি, এও তো আমার লিখবার কথা নয়। কিন্তু লিখছি তো। আপন বলেই আপনারাও আপন করে কাছে টেনে নিলেন! কি অদ্ভুত যোগাযোগ বলুন দেখি!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ আছে। যোগাযোগটা সরাসরি কিংবা শারীরিক নয়- আত্মিক। মুক্তিযুদ্ধের গল্প পেলেই আমি শুনতে বসে যাই। মুক্তিযোদ্ধা বীর কাউকে পেলে অপেক্ষায় থাকি কখন তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার সোনাঝুড়ি মেলে ধরবেন। আর সব জায়গার মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিল। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সহ বিভিন্ন  আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স সবে মাত্র পাঁচ বছর। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর যাত্রা শুরু করেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৯৬৬! আহা! এই ‘৬৬ সালেই রচিত হয়েছিল বাঙালীর মুক্তির সনদ। ‘৬৬-এর ফেব্রুয়ারিতে সেসময়ের পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে একটি সন্মেলন হয়। সে সন্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন।  সেকারণে ‘৬৬ সাল বড় গুরুত্ববহ।

শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়টি কোথায় প্রতিষ্ঠিত হবে তা নিয়ে যথেষ্ট মতদ্বৈততা ছিল। একবার কথা চলল চট্টগ্রামেই হবে। আবার দ্বিমত পাওয়া গেল, না, বিশ্ববিদ্যালয় হবে কুমিল্লায়। ফলে গেল শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করতে বড় ধরনের আন্দোলন শুরু করে এবং তারই ফলশ্রুতিতে আজকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আপন অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেল।

একাত্তরের মার্চে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি লালদিঘীর ময়দানে অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে সপ্তাহব্যাপী এক কর্মসূচি করেছিল। রোজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেতৃত্বে শহরের প্রধান রাস্তাগুলোতে ট্রাকের ওপর র‌্যালি হতো। তাঁদের সঙ্গে থাকত নানান স্লোগান লেখা পোস্টার, ফেস্টুন আর প্ল্যাকার্ড। চলত দেশাত্মবোধক গান। লালদিঘীর সে সভা চলত গভীর রাত অবধি। যাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একাত্ম হয়েছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজন আর সংস্কৃতিকর্মীরা।

এরপর শুরু হলো মুক্তির যুদ্ধ।  সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের তিন বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর শিক্ষকরা যুক্ত ছিলেন; কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী।

নয়টি মাস যুদ্ধ করে আমরা বিজয়ী হলাম। তবে মুক্তির এ যুদ্ধে মুক্তি কতটুকু এল সেটি একটি প্রশ্নবোধক হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। গেল বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চান্ন বছর পূর্তিতে সাবেক এক শিক্ষার্থী আক্ষেপে বলেছিলেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স পঞ্চান্ন পেরোল এবার। কিন্তু এত বছরেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কি সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পেরেছে? … গত ৫৫ বছরে কতজন গবেষক তৈরি করতে পেরেছে ইংরেজি বিভাগ? অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো কলা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোতে গবেষণাকে খুব পরিষ্কার ভাষায় নিরুৎসাহিত করা হয়। মাস্টার্সে থিসিস করানো হয় না। পিএইচডি এমফিলে ভর্তির ন্যূনতম যোগ্যতা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে কোনো কোনো বিভাগের প্রথম-দ্বিতীয় স্থান অধিকারীরাও আবেদন করতে পারেন না। নানা সময়ে এই ব্যাপারে আগ্রহীরা শিক্ষকদের দ্বারস্থ হলেও কোনো সুরাহা হয় না। এদিকে এই অনীহার কারণে অনেক শিক্ষার্থী আগ্রহ থাকার পরও গবেষণা কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই জায়গায় চবি পুরোপুরি ব্যর্থ।”

ভদ্রলোকের আট বছরের শিক্ষাজীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কখনও তাঁর শিক্ষার্থীবান্ধব মনে হয়নি। এই ব্যর্থতা আসলে কার? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের? নাকি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার? অথবা আমাদের মানসিকার? প্রশ্নফগুলোর উত্তর কিন্তু আমাদের অজানা নয়। এই যে আজকে আপনারা যারা সমবেত হয়েছেন- আপনাদের সকলের কাছেই এর উত্তর রয়েছে। যেমন ধরুন শিক্ষাজীবনে আমরা কি নিয়ে পড়েছি আর জীবিকা নির্বাহে এখন কি করছি। অথবা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদেরকে কিভাবে নির্মাণ করেছে। হোক সেটি ঢাকা, রাজশাহী কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

আজকে দেশ থেকে এতটা দূর এই সুদূর প্রবাসে দেশের একটি শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীরা এক জোট হয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে। এই সংগঠন গড়ে তুলবার পেছনে তাদের প্রবল দেশপ্রেম আর ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দায়বোধটিও বিদ্যমান। কেননা শিক্ষা মানুষকে পশ্চাৎমুখীতা থেকে অগ্রসরমান করে তোলে। আধুনিক ও দক্ষ করে মানুষকে। ফলে এ দায় কেবলই দেশপ্রেমে সীমাবদ্ধ নেই। দেশের জন্যে কিছু একটা করবার তাগিদও বটে। আমরা সে তাগিদটার বাস্তবায়ন রূপ দেখবার প্রতীক্ষায় রইলাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকা ইনকের ২৯ বছর পূর্তিতে সকল সদস্য ও সংশ্লিষ্ট সকলকে আবারও আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

তবে সকলে যদি দেশের নামে সন্মিলিতভাবে একটি সংগঠন গড়ে তার নীচে নিজেদের সংগঠিত করত, তাহলে ভালো লাগাটাও আরও বাড়তো বটে।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing