চেতনায় মানবিক মূল্যবােধ

0 comment 79 views

আমরা সকলে জানি পৃথিবীর সকল জাতি মিলে একটি সংগঠন বানিয়েছে। সংগঠনটির নাম-জাতিসংঘ। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যটি হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা। মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করার অন্যতম অংশটি হলো নির্যাতন। নির্যাতনের সংজ্ঞা বলছে, নির্যাতন হলো ‘অবহেলা’।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আপনি যখন কাউকে নিজের থেকে ছোট কিংবা নিকৃষ্ট ভাবছেন। এই ভাবনা আপনার উপলব্ধিকে তার সঙ্গে যা খুশি তা করবার পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে। সেকারণে আপনি ভাবছেন আপনি ইচ্ছে করলেই তার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারেন, এবং করছেনও। জাতিসংঘ বলছে, ঠিক একারণেই কাউকে অবহেলা করা যাবে না। এজন্যে জাতিসংঘ পৃথিবীর সকল নির্যাতিতদের পক্ষ নিয়ে তাঁদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার বলে মনে করেছে। আর সেই মনে করা মনে করিয়ে দিতেই ১৯৯৭ সালের ১২ ডিসেম্বরে নির্যাতিতদের জন্য একটি দিবস ঘোষণা করেছিল। ১২ ডিসেম্বর ঘোষণা করলেও দিবসটি পালন করা হয় ২৬ জুন। আজকে আমার অবস্থাই জাতিসংঘের মতোই- ২৬ জুন নির্যাতনবিরোধী দিবস হলেও আজকে, জুলাইয়ের ৫ তারিখে নির্যাতনবিরোধী দিবস নিয়ে লিখছি।

২৬ জুন একটি বিশেষ দিন এবং কাঙ্ক্ষিত দিন। আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস। প্রতি বছর ২৬ জুন এ দিবসটি পালন করা হয়। পৃথিবীতে সকল ধনের নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক আচরণের শিকার যারা, যারা আজও বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত জন্যে জাতিসংঘ ঘোষিত সে দিন। আজ সারা বিশ্বে মানুষ যাতে নির্যাতনের শিকার না হয় তার বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে।

যে কোনো নির্যাতনই নিন্দনীয় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুর্বল মানুষই বেশি নির্যাতনের শিকার হন। কে দুর্বল? প্রবীণ, নারী ও শিশুরাই বেশি দুর্বল বলে তারা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সহায়সম্বলহীন মানুষ, যারা শ্রম বিক্রি করেন, তারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনকারী যখন বুঝতে পারে—নির্যাতিত ব্যক্তির প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা দুর্বল—তখন সে নির্যাতন করতে কম দ্বিধা করে। কারণ, নির্যাতনকারী মনে করে, ঐ দুর্বল মানুষটিকে নির্যাতন করলেও কিছু হবে না বা হলেও তা মোকাবিলা করার ক্ষমতা তার আছে।

২৬ জুনে বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা একটি খববরের শিরোনাম করেছে ‘রিমান্ড ক্রিয়েটস্‌ স্কোপ ফর টরচার’। বাংলাদেশ পুলিশের এক আইজি বলেছিলেন, মানুষকে শারীরিকভাবে নির্যাতন না করা যাবে না। মানুষের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে। মানুষকে যে নির্যাতন করা যাবে না সেটা তো আইনেই রয়েছে, তাহলে আইজিকে ঘোষণা দিয়ে জানাতে হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কখনও জানা যাবে না।

তবে নির্যাতন আসলে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে একলাই করে না, বস্তুত নির্যাতন আসলে করেন নিজেকে যিনি সবল ভাবেন তিনিই। আর নির্যাতনটা করা হয় সবল যাকে নিজের থেকে দুর্বল মনে করেন। ক’দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ছবি ভাসতে দেখা গেল এক বাদাম বিক্রেতার কাছ থেকে একজন বাদাম কিনেছিল। কেনা বাদামে কিছু বাদাম নষ্ট ছিল। সেকারণে সবল ক্রেতা বাদাম বিক্রেতার সব বাদাম ফেলে দিয়েছে। দুর্বলকে সবলের এই নির্যাতন সারা বিশ্ব জুড়েই বিদ্যমান। এই নির্যাতন কেবল ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ নয়। দুর্বল দেশও সবল দেশগুলোর কাছে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। এই নির্যাতন অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার লক্ষ্যে। যেভাবে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে অধিকার করেছিল।

সমগ্র প্রাণি জগতেই দুর্বলের ওপর সবলের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলমান। বড় মাছ ছোট মাছকে খায়। শক্তিশালী মাংসাশী প্রাণি তার চেয়ে দুর্বল প্রাণিকে শিকার করে। মানুষও তার থেকে দুর্বল আর দরিদ্রকে নিষ্পেষণ করে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ অসভ্য থেকে সভ্য হয়েছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়া এখনও চলমান। মানুষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সবসময়ই ভালো ও মন্দ- দু রকমের শাসকগোষ্ঠীই দৃশ্যমান ছিল। আছে এখনও। আর সমাজে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ছিল প্রভু-ভৃত্যের মতো। সেকারণে কখনও কখনও এই অধিকার দুর্বলের ওপর অত্যাচারে রূপ নিয়েছে।

আমরা এখন নিজেদের সভ্য দাবি করি। আধুনিক ও শিক্ষিতও দাবি আছে আমাদের। কিন্তু অভ্যন্তরে সেই অসভ্য সময়ের রিপু রয়েই গেছে। মানবিক এখনও হতে পারি নি আমরা। সেজন্যে মানবতার কথা জোর গলায় বলতে হয়, মানবিকতা প্রতিষ্ঠায় সংগঠন বানাতে হয়, আইন তৈরি করতে হয়- কিন্তু এরপরও নিত্যই নির্যাতনের খবরে খবরের কাগজের পাতাগুলো ভরতেই থাকে। চলতে থাকে দেশে দেশে যুদ্ধ। যুদ্ধ হলো নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি।

নির্যাতিতদের পুনর্বাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক পরিষদের সদর দফতরটি ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহাগেনে। এই পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, নির্যাতননকারীরা যাতে জয়ী না হতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সারা পৃথিবীতে চোখ বুলালে আমরা দেখতে পাই শুধু নির্যাতিতদের জয় জয়কার- কেননা তাদের অর্থনৈতিক শক্তি প্রবল। ফলে তারা প্রভাবশালী। সমাজের সকল কিছুতেই তাদের প্রভাব। সেকারণে তারা বাদাম বিক্রেতার বাদাম ছিনিয়ে রাজপথে ছড়িয়ে দিলে কিংবা হিরোশিমায় অ্যাটম বোমা মেরে দিলে, অথবা রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্পত্তি বলে ঘোষণা দিলেও এদের কিছুই হয় না।

আমাদের বাবা-মায়েরা চাইত ছেলেমেয়ে যেন লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত মানুষ হয়। এখনকার বাবা-মায়েরা চান ছেলেমেয়ে যেন লেখাপড়া শিখে ডাক্তার ইঞ্জিয়ার অথবা সরকারি চাকুরে হয়। লেখাপড়ার উদ্দেশ্যটাই পালটে গেছে। এখনকার মানুষদের মাঝে তাই মানবিক গুণাবলীর অভাব দেখা দিয়েছে। ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও শিষ্টাচারকে মানবিক মূল্যবােধের ভিত্তি বলা হয়। মানবিক এই মূল্যবােধগুলো চলতি পথে আমরা ক’জনের মধ্যে দেখতে পাই কেউ কি বলতে পারেন।

বড়দের সম্মান করা, আর্তের সেবা করা, উত্তম ব্যবহার, সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা যদি হয় মানবিক মূল্যবােধের উদাহরণ- তাহলে বলুন তো আপনার চেনা ক’জন মানুষ এইগুলো ধারণ করেন? নির্যাতনবিরোধী দিবস কেবল একটি দিন নয়, একটি উপলব্ধি। এই উপলব্ধির বসবাস আপনার চেতনায়। আসুন তাকে আমরা জাগিয়ে তুলি।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing