চাইছি বন্ধুর বন্ধুতা

0 comment 63 views

মইনুল ইসলাম মানুষটি কঠিনরকম ব্যবসায়ি মানুষ। কঠিনরকম ব্যবসায়ি বলেই এ বয়সে এসেও তিনি ভীষণভাবে সফল হয়ে উঠেছেন। এমন মানুষেরা বন্ধু হন না। কিংবা বলা যেতে পারে,  এমন মানুষেরা বন্ধু হিসেবে উৎকৃষ্ট হন না। এই অবস্থানে থাকা মানুষেরা সাধারণত ব্যবসায়িক সম্পর্কটি গড়েন কেবল। কেননা বন্ধুত্বের যে সংজ্ঞা, ওর প্রধানতম উপাদানটি- আবেগ। একজন কঠিনরকম ব্যবসায়ি ভীষণরকম আবেগী মানুষ হয়ে উঠে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠবেন- ব্যাপারটা মেনে নিতে মন হৈহৈ রৈরৈ করে সায় দিয়ে আপ্লæত হয়ে উঠবে, এমনটি ভেবে নেয়ার পক্ষে মনের কাছে কোনো কারণ বিদ্যমান নয়।

‘আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম যে আমার

পিতৃশোক ভাগ করে নেবে, নেবে

আমার ফুসফ‚স থেকে দুষিত বাতাস;

বেড়ে গেলে শহরময় শীতের প্রকোপ

তার মুখ মনে হবে সবুজ চয়ের প্যাকেট, …’

…আমি এই ঢাকা শহরের সর্বত্র, প্রেসক্লাবে, রেস্তরাঁয়, ঘোড়দৌড়ের

মাঠে এমন একজন বন্ধু খুঁজে বেড়াই যাকে আমি

মৃত্যুর প্রাক্কালে উইল করে যাবো এইসব অবৈধ সম্পত্তি, কুৎসা

আমার লাম্পট্য, পরিবর্তে সে আমার চিরদিন যোগাবে ঘুমের ওষুধ

আমার অপরাধের ছুরি রেখে দেবে তার বুকের তলায়, …’

(বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন/ মহাদেব সাহা)’…

কবি মহাদেব সাহা একজন বন্ধুর খোঁজে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়ে অবশেষে ‘বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন’ দিয়েছেন। পুরো একটা জীবন কেটেছে তাঁর একজন বন্ধুর অপেক্ষায়। পুরো একটা জীবন তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন বন্ধুহীনতায়। কি অসম্ভব একটা ট্রাজেডি ভাবুন তো! সত্যিই কি তাই! কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে কবি মহাদেব সাহা একজন বন্ধু কি সত্যিই খুঁজে পান নি! আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি অমন একজন বন্ধু একজন মানুষের জীবনে কতটা কাঙ্ক্ষিত।

আমার কোনো বন্ধু নেই। আমার কোনো বন্ধু ছিল না। বন্ধু বলে যাদেরকে জেনেছি, একটা সময়ে পৌঁছে জানতে পেলাম তারা আসলে বন্ধু হয়েও বন্ধু হয়ে ওঠে নি কখনো। আমিই বোকার মতো খুব সযত্নে বন্ধুর জন্যে পরিপাটি করে আগলে রাখা আসনটিতে অধিকার দিয়েছি তাকে।

বন্ধু শব্দটার যে গভীর একটা আবেদন রয়েছে, সেটাকে আজকাল খুব সস্তা করে ফেলা হয়েছে। খুব খেলো করে ফেলা হয়েছে। এবং আজকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসে তাতে ঘি ঢেলেছে। এখনকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নামের মাধ্যমটিতে ব্যক্তির নিজের একটি জায়গা থাকে। তার সঙ্গে যারা যুক্ত হয় তাদের পরিচয়টি ‘বন্ধু’ হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছে তারা। ফলে ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেছে হাজারে হাজারে বন্ধুবান্ধব আপনার। আর আপনার সে বন্ধু তালিকায় এমন এমন মানুষ রয়েছেন যাদের সঙ্গে আপনার কোনোদিন দেখা হওয়া তো দূর, জীবনে আলাপও হয় নি। হবে যে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং নিশ্চয়তাটুকু অনেকটা নির্দ্বিধায় ‘না ভোটের’ বাক্সেই দেয়া যেতে পারে। এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, ‘তাতে আপনার সমস্যা কি?’

না, আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ‘বন্ধ’ শব্দটিকে, ‘বন্ধু’ সম্পর্কটিকে এভাবে সস্তা বানিয়ে ফেলায়, এভাবে খেলো করে ফেলায় আমার আপত্তি আছে।

বন্ধু একটি সম্পর্ক। মানুষের বড় আপনজন। বন্ধু মানুষের জীবনের সকল সম্পর্ককে ছাপিয়ে উঠে শীর্ষে অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। সবচেয়ে আপন। সবচেয়ে আপন বলেই ভিন্ন একটি সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতে আমরা সে সম্পর্কতে বন্ধুত্বের প্রলেপ লাগাই। আজকাল অনেক মা-ই বলে দেন, আমার মেয়ে তো আমার বন্ধু! বাবা বলেন, আমার ছেলেটার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাপ-ছেলের নয়, আমরা বন্ধুর মতো। স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরকে নিজেদের বন্ধু বলে দাবি করেন। এভাবে যে কোনো অসম সম্পর্ককে সহনীয় করতে কিংবা প্রগাঢ় বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে সে সম্পর্কের ওপর বন্ধুতা চাপিয়ে দেয়া হয়। কেননা  আত্মার সঙ্গে আত্মার শক্ত বন্ধনই বন্ধুত্ব। গবেষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দারুণরকম গবেষণা চালিয়ে জানিয়েছেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কারণে মানুষ সুখি হয়। বন্ধুত্ব মানুষের জীবনে বিশ্বাস, আনুগত্য এবং প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। হয়ত সেকারণেই সমাজবিদ্যা, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, আর দর্শন শাস্ত্রে বন্ধুত্ব শিক্ষা দেয়া হয়।

যে সম্পর্কটি এত এত গুরুত্ব বহন করে, হালের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সেটিকে যখন নিজেদের পুঁজি বানিয়ে ফেলে ব্যবসায় লগ্নি করে- আমার তাতে নিশ্চয়ই আপত্তি আছে। একটু আগে আমার কোনো বন্ধু না থাকার কথা বললাম, এরও কারণ আছে। কবি মহাদেব সাহার মতো আমিও একটি বন্ধু খুঁজছিলাম, যে বন্ধুটি-

…‘আমার

পিতার কাছে

চিঠি দেবে এই বলে-ওর কথা ভাববেন না, ও বড়ো ভালো ছেলে

নিয়মিত অফিস করে দশটা পাঁচটা ; অথচ সে জানবে আমার

সব বদঅভ্যাস, স্বভাবের যাবতীয় দোষ’…

…মফস্বল শহরগামী কোনো এক ট্রেন চড়ে নেমে যাবে

আমার সাথে ভুল ইস্টিশনে;

এখনে ওখানে সর্বত্র আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম…’

(বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন/ মহাদেব সাহা)

তবে বন্ধুর গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা জানলেও আমি জানতাম না বন্ধু কোথায় পাওয়া যায়। সেকারণে আমার কোনো বন্ধু ছিল না। ছেলেবেলা থেকে বেড়ে উঠতে উঠতে বন্ধু বলে যাদেরকে জেনেছি, একটা সময়ে পৌঁছে জেনে গিয়েছিলাম তারা আসলে বন্ধু হয়েও বন্ধু হয়ে হয় নি কখনো। তখন ‘বন্ধু’ সংজ্ঞাটিকে আমার কাছে ‘ফেইরি টেল’ বলেই মনে হতে লাগল।

কিন্তু আমার ধারণাটি সঠিক ছিল না। আবহমানকাল থেকে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটি তো আর এমনি এমনি হয় নি। যেমন ধরুন ‘শত্রু’ সম্পর্কটি; এইটি তো প্রবলভাবেই সত্য। আমি, আপনি প্রতিনিয়ত আমাদের আপনাপন জগতে এইটি খুব করে অনুভব করি। বন্ধুর অবস্থান তো শত্রুর বিপরীতে। তাহলে বন্ধু কেন থাকবে না? আছে তো। থাকে আসলে। আমরাই মানুষটির সন্ধান পাই না। কেউ কেউ পায় বটে। সকলে পায় না। যারা পায় তারা ভাগ্যবান বড়।

জীবনের প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। নতুন জায়গায় গেলে তখন সেখানকার নানান মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। সামাজিক নিয়মেই তারা বন্ধুবৎসল হন। হতে হয় আসলে, সকলকেই। এই-ই সভ্যতা। কিন্তু বন্ধুবৎসল হওয়া আর বন্ধু হওয়া এক কথা নয়। কেউ কেউ বন্ধু হন, হয়ত। আবার হনও না। চলে আলাপচারিতা। তাতে সম্পর্কটার ভিত্তি মজবুত হয় বটে। চলে সুখ-দুঃখের গল্প। চলে হাসিঠাট্টা। সম্পর্ক একটা গড়েও ওঠে। কিন্তু সে সম্পর্ক সবসময় বন্ধু নয়। সেটি প্রতিবেশি কিংবা সহকর্মী অথবা পরিচিত। বন্ধু নয় সবসময়। বন্ধু হওয়া বড় কঠিন। বন্ধু পাওয়া আরো কঠিন। সুভাগ্যের লোকেরাই একজন সত্যিকার বন্ধু পায়। আর বাকিরা ‘মহাদেব সাহা।’

অবশেষে জানা গেল আমিও দুর্ভাগা নই। মহাদেব সাহা হতে হতে এই নিউ ইয়র্কে এসে  আমিও একজন বন্ধু পেয়ে গেলাম।

মইন মানুষটি কঠিনরকম ব্যবসায়ি মানুষ। কঠিনরকম ব্যবসায়ি বলেই এ বয়সে এসেই তিনি ভীষণ সফল হয়ে উঠেছেন। এমন মানুষেরা বন্ধু হন না। ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়েন। কেননা বন্ধুত্বর যে সংজ্ঞা ওর প্রধানতম উপাদান হলো আবেগ।

বন্ধু হলো বন্ধুর আনন্দে নিজেও বিমল আনন্দ ভেসে যাওয়া। কিংবা ধরুন খুশির খবরে লাফিয়ে ওঠা। অথবা বন্ধুর দুঃখ সময়ে কাতর হয়ে উঠে আর কিছু না পারুক, পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলতে থাকা, ‘ভাবিস্ না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি না!’

নিউ ইয়র্ক সিটির মতো পৃথিবীর ব্যস্ততম শহরের একজন সফল রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ি বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে আড্ডাবাজি করবেন, হেসে হেসে গড়াগড়ি খাবেন, পাগলামির চূড়ান্ত করবেন এইটি যদি বাস্তবতায় ঘটেও যেত তবুও যেন মন মেনে নিত না।

না, বাস্তবে সেটি আসলে ঘটেও নি। কিন্তু তার কমও কিছু যে হয়েছে, তাও নয়। যেমন, হঠাৎ একদিন মইন এসে বললেন, ধুর! কত কাজ করবেন! কি করবেন এত টাকা দিয়ে? চলেন তো, আজকে ছুটি। তারপর আমরা ক’জনা গেলাম শপিংয়ে। কিনে ফেললাম প্যাকেট করা খাবার আর পানীয়। তারপর চলে গেলাম নিউ ইয়র্ক শহরের প্রান্তের কোনো উদ্যানে। সেখানে চলল দিনমান আড্ডা আর হাসি। সময় আর পৃথিবী তখন শুধুই আমাদের- বন্ধুদের। আমি খুব করে নিশ্চয়তায় বলতে পারি যদি কখনো দুঃখ-সময় আসে, আমার এই বন্ধুটি আমার কাঁধ ছুঁয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলবে, ‘ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি না!’

বন্ধু নিয়ে বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এরিস্টটলের একটি কথা মনে পড়ল। এরিস্টটল বলেছেন, ‘প্রতিটি নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরনো হয়, ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়।’

সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বন্ধুত্ব এখন আরও প্রগাঢ় হয়ে আমাদের দু পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের মতো করে আমাদের স্ত্রীরাও পরস্পরের বন্ধু। ঠিক একই ধারায় সন্তানেরাও বন্ধু হয়েছে। কেননা বন্ধুত্বর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। নেই কোনো বয়স সীমার গণ্ডিতে বাঁধা।

আমি খুব অহংকার নিয়ে বলতে পারি, এই সংলাপটি বলতে পারার মতো নিউ ইয়র্কে এখন আমার আরো ক’জনা বন্ধু আছেন। আর আমি গর্বিতভাবেই বলতে চাই, দিন শেষে এই বন্ধুরাই আমার সত্যিকারের উপার্জন।

প্রকাশকাল: অনুস্বর, জানুয়ারি ২০২২।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing