আজ থেকে দু বছর আগে আমাদের এই নিউ ইয়র্ক শহরে ফাহিম সালেহ নামে একটি ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছিল। সেই মেরে ফেলাটা ছিল একটা ভয়াবহ ব্যাপার।
যখন মেরে ফেলা হয়, ফাহিম তখন তেত্রিশ বছরের যুবক। মেরেছিল ফাহিমেরই এক সহকারী টাইরেস ডেভন হ্যাসপিল। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান রডনি হ্যারিসন জানিয়েছেন, ফাহিম হ্যাসপিলের কাছে মোটা অংকের টাকা পেত। সে টাকা শোধ যেন করতে না হয়, সেজন্যেই ফাহিমকে মেরে ফেলে হ্যাসপিল। মারবার পর ফাহিমকে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে গার্বেজ ব্যাগে ভরে ফেলে।
১৯৯১ সালে তামিলনাড়ুতে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। সেসময় এক নারী এলটিটি কর্মী নিজের গায়ে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হামলা চালায়। সে হামলায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান রাজিব গান্ধী। এ বছরের মার্চে রাজিব গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধী ও মেয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তাদের বাবার খুনিদের ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। যে কারণেই হোক, তারা কোনো ধরণের হিংসা চান না। তাই তাদের বাবাকে খুনের নির্দেশদাতা এলটিটি প্রধান প্রভাকরণের মৃত্যুতেও তারা কষ্ট পেয়েছেন।
বিষয়টার মধ্যে একটা মহানুভবতা রয়েছে। রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা রাজনীতির মানুষ। ফলে এর মধ্যে রাজনীতিও হয়ত রয়েছে। কিন্তু আমরা যারা রাজনীতির বাইরের মানুষ, আমরা মনে করি প্রতিটা অপরাধ ও অপরাধীরই শাস্তি নিশ্চিত হওয়া দরকার। জরুরিও বটে। কেননা বাংলাদেশে আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখেছি। এবং একই সঙ্গে তার খেসারতও আমরা দীর্ঘদিন দিয়েছি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে তারা যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছিল, তাদেরকেই সে রাষ্ট্রটির গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করতে দেখেছি। ফলে তাদেরকে ভীষণ স্পর্ধায় পুরো জাতির সামনে বলতে দেখেছি, বাংলাদেশে কোনও যুদ্ধাপরাধী নেই! দেখেছি আইন করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচার না করতে দেয়ার প্রয়াস। এদের উদ্ধত চলাফেরা আচরণের জন্যে আসলে বিচার না হওয়ার সংস্কৃতিই দায়ী। আর এই দায় থেকে মুক্তি তখনই ঘটবে যখন প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা ফাহিম ছেলেটা কেমন প্রতিভা ছিল সেটি এখন আর নতুন করে বলবার নেই কিছু। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সেই এই ছেলে বাংলাদেশে ‘পাঠাও’-এর মতো একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। এরপর নাইজেরিয়ায় গোকাডা নামে একটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেছিল। নিউ ইয়র্কের গণমাধ্যম ফাহিমকে ‘টেক মিলিওনিয়ার’ আখ্যা দিয়েছিল। নিজেকে ফাহিম পরিচয় দিত অন্ট্রেপ্রেনিওর, ইনভেস্টর, ড্রিমার। মানে উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, স্বপ্নবাজ।
এই স্বপ্নবাজ ছেলেটিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে তারই সহকারী টাইরেস হ্যাসপিল অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে খুন করেছে। তারপর লাশ লুকাবে বলে ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করেছে।নিউ ইয়র্ক পুলিশ জানিয়েছে, ফাহিমের বোন রুবী সালেহ যখন ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্টে যাচ্ছিলেন তখন হ্যাসপিল ফাহিমকে কেটে টুকরাে টুকরাে করছিল। ফাহিম সালেহ’র বােন উপরে উঠে আসার আগে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়।
পুলিশ টাইরেস হ্যাসপিলকে গ্রেপ্তার করেছে। মামলা আদালতে উঠলে খুনি টাইরিস ডেভন হসপিল আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে! যে ফাহিম হত্যার ঘটনাটি বিশ্ব গণমাধ্যমকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। হত্যার নৃশংস বর্ণনায় পুরো পৃথিবীর মানুষ তীব্র ঝাঁকুনি খেয়েছিল, সেই হত্যাকারী আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করছে!
ফাহিম হত্যার ঘটনাটি শুধু একজন মানুষকে মেরে ফেলা হিসেবে আমরা দেখছি না। ফাহিম সালেহ্ হত্যা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এই ক্ষতি আমরা মেনে নিতে রাজি নই। আমরা খুনি টাইরিস ডেভন হ্যাসপিলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এমন শাস্তি চাই যেন আর কোনও হ্যাসপিল কখনও কোনও ফাহিমকে হত্যা করবার কথা ভাবতে না পারে।