ক্ষুধা

0 comment 69 views

মনে করুন, আপনারা আট ভাইবোন। বাবা-মা পরিবারে দশজন সদস্য। রাতের খাবার রান্না হয়েছে। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় সকলের একসঙ্গে ঘরে ফেরা হয় না। সারাদিন কাজ শেষে যিনিই ঘরে ফেরেন, তিনি হয়ে থাকেন ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুধার্ত। সেকারণে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার হয়ে খেয়ে নিয়ে শরীরটা এলিয়ে দেন বিছানায়।

এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপারটা হলো, যিনি সবার শেষে ফিরলেন তিনিও ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুধার্ত। তিনি যখন পরিষ্কার হয়ে ক্ষুধা মেটাতে গেলেন, দেখলেন কোনো খাবার অবশিষ্ট নেই। তার তখন কিছুই করার নেই। তাই চুপ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমোতে গেলেন। কিন্তু ক্ষুধা পেটে ঘুম কি আসে? তবুও ক্ষুধার সঙ্গে ক্লান্তি আর পরিশ্রম তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। রোজই এমন হয়, ওই বাড়ির কেউ না কেউ রোজই না খেয়ে ঘুমোতে যায়। পরেরদিনেও খেতে পাবে তাও জানে না।

আচ্ছা, নিউ ইয়র্কের জনসংখ্যা এখন কত? বছর দুয়েক আগের হিসেব অনুযায়ী প্রায় পঁচাশি লক্ষ। দু বছরে সে সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে। তাহলে নিউ ইয়র্কে রোজ সাড়ে আট হাজার মানুষ না খেয়ে ঘুমোয়। এটি আমার কথা নয়, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের কথা।

এই মুহূর্তে বিশ্বের ৭০ কোটি মানুষ জানে না, তারা আবার কখন খেতে পাবে কিংবা আদৌ পাবে কিনা। আর ৭৮ কোটিরও বেশি মানুষ অর্থাৎ প্রতি দশ জনে একজনকে রোজ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমোতে যেতে হয়। সাড়ে ৩৪ কোটিরও বেশি মানুষের কাছে খাদ্যের কোনও নিরাপত্তা নেই।

খাদ্য নিরাপত্তা। খাবার। মানুষ পাঁচটি অধিকার সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে জন্মায়- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আর মানুষের এই পাঁচ অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। দেখুন, প্রথম অধিকারটিই খাদ্য। বাকিগুলো আপাতত ছেড়ে দিন। খাবার তো বেঁচে থাকাটা নিশ্চিত করে। আগে তো বেঁচে থাকতে হবে, তারপর না হয় বাকি চারটি নিয়ে ভাববেন।

আপনি হয়ত বলবেন, নিউ ইয়র্কের বিষয়ে আমি ঠিক বলি নি। নিউ ইয়র্কে রোজ সাড়ে আট হাজার মানুষ না খেয়ে থাকে না। আপনার মতের বিরোধিতা আমি করব না। কেননা নিউ ইয়র্কে রোজ কোনো না কোনো সংগঠন যে খাদ্য সহায়তা দেয়, সেসব খাদ্য সহায়তা যারা নেয় তারা নিউ ইয়র্কের অধিবাসী কিনা আমার জানা নেই।

পৃথিবীর জল-স্থলকে আমরা যেভাবে ভাগ করেছি, তেমনি পৃথিবীকেও আমরা তিন ভাগে ভাগ করেছি। এই তিন ভাগের দুটোর পরিচয় আমি জানি, একটি প্রথম বিশ্ব, অন্যটি তৃতীয় বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্ব পৃথিবীর কোন্ অঞ্চলে রয়েছে আমার জানা নেই। মানুষের শ্রেনিভেদেও মানুষকে আমরা তিন ভাগে করেছি। এই তিন ভাগ আমরা সবাই জানি, কেন জানি জানেন? কারণ ভাগ করার উপাদানটির নাম বিত্ত। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান দিয়ে আমরা তৈরি করেছি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত।

নিউ ইয়র্কে রোজ দেওয়া খাদ্য সহায়তা যারা নেন, তারা ওই মধ্যবিত্ত শ্রেনিটি বলেই মনে হয়। নিজের অপ্রতুল আয় দিয়ে এরা চলতে পারে না, আবার কারও কাছে হাত পেতে চাইতেও পারে না। তাই যখন দেখে কোথাও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, মাথা নিচু করে লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। নেয়ও মাথা নিচু করেই। প্রথম বিশ্বে এদেরই কেউ না কেউ রোজ না খেয়ে ঘুমোতে যায়। তৃতীয় বিশ্বে সত্তর ভাগ মানুষই নিম্নবিত্ত। বিশ-বাইশ ভাগ মধ্যবিত্ত। সকল সম্পদ তো ওই বাকি আট দশ ভাগ উচ্চবিত্তদেরই।

সেকারণে এখন ক্ষুধার সঙ্কট ক্রমবর্ধমান। বিশ্ব জুড়ে একটা ডিমের দাম সাড়ে পাঁচ টাকা। বাংলাদেশে সেই ডিমের দাম সাড়ে বারো টাকা। আমাদের মুবিন খান এ বছর শাহ্ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কোরবানির মাংস দেওয়ার এক লোককে জিজ্ঞেস করেছিল, শেষ কবে মাংস খেয়েছে? লোকটি লাজুক মুখে বলেছিল, গত ঈদে।

মানুষের অভাব-অনটন বেড়েই চলেছে। কিন্তু আসল অভাবটার নাম মানবিকতা। নয়ত করোনা মহামারীতে পৃথিবী জুড়ে যে বিপর্যয় ঘটেছে সেটা কাটিয়ে উঠতেই তো কয়েক দশক লেগে যাবে। অথচ দেখুন, মহামরী কাটতে না কাটতে অহংকারী দুই নির্বোধ যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে। আর সে যুদ্ধ থেকে ফায়দা লুটতে অন্যেরাও দু দলে ভাগ হয়ে দুই নির্বোধের পক্ষ নিয়ে গলাবাজি করছে।

যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে এরা যে পরিমাণের টাকা ঢালছে সে টাকা যদি মানবিকতার জন্যে খরচ করত- বিশ্বাস করুন পৃথিবীর একটি মানুষও না খেয়ে থাকা তো দূর, কোনো মৌলিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত হতো না।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাদের কথা দিয়েই শেষ করি। তারা বলছে, সামরিক সংঘর্ষ, অর্থনৈতিক ধাক্কা, পরিবেশের সঙ্কট এবং সারের দামবৃদ্ধি। এসব কারণে ৫০টি দেশে ৪ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের ঠিক আগের অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। পাঁচের কম বয়সি সাড়ে চার কোটি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।

এগুলো আন্তর্জাতিক ব্যাপার। আমরা এসব বড় বড় মানুষদের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের হিসেব বা কথাবার্তা বুঝব না। কিন্তু আমার আপনার আশেপাশের প্রতিবেশীটি না খেয়ে আছে কিনা, কষ্টে আছে কিনা- এটুকু তো বুঝব, তাই নয়? চলুন না নিজের তার দিকে হাতটি বাড়িয়ে দিই। নয়ত পাশের বাড়িতে থাকা মানুষটি পানি খেয়ে ঘুমাতে গেছে জানলে আপনার চোখে ঘুম আসবে?

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing