ক’দিন আগে নিউ ইয়র্কের টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা চ্যানেল বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাওয়া বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে। প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার আদাবরের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমিনা বেগম নিজের ভাড়া বাসা ছেড়ে স্কুলের দু’টা কক্ষেই এখন নিজের সংসার পেতেছেন। আমিনা বেগম জানিয়েছেন, সম্প্রতি সরকার স্কুল খুলে দিলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন অর্ধেকেরও কম। তিনি এখনো শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না। পারছেন না স্কুল ভবনের ভাড়া পরিশোধ করতে। তবে এই বাস্তবতা শুধু আদাবরের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটির একলার নয়।
কিন্ডারগার্টেন হলো শিশুদের প্রাক-বিদ্যালয় বা বিদ্যালয়-পূর্ব উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮১৬ সালে স্কটল্যান্ডে রবার্ট ওয়েন নামক একজন দার্শনিক ও শিশু শিক্ষাবিদ নিউ ল্যানার্কে ‘ইনফ্যান্ট স্কুল’ খুলেছিলেন। এরপরে ১৮৩৭ সালে জার্মান শিশু শিক্ষানুরাগী ফ্রেডরিখ ফ্রোয়েবেল এক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রবর্তন করেন। সেখানকার ব্যাড ব্ল্যাংকেনবার্গে শিশুদের বাড়ি থেকে স্কুল অবধি যাওয়া-আসা ও খেলাধুলার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের ধারণাটিই আজকের কিন্ডারগার্টেন স্কুল। জার্মানির কোগেল শহরে কিন্ডারগার্টেনের অপূর্ব চিত্র বিশ্বের অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার সবার আগে যে পদক্ষেপটি নিয়েছে সেটি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখা। দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি মানসিকভাবেও তারা ভালো থাকে নি। এর সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাবটি পড়ছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর। শিশু শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকতাও শেখে। আর স্কুলে অনেকে মানুষের মধ্যে সমবয়সীরাও থাকবার ফলে তাদের সে শেখাটা একটা আলাদা মাত্রা পায়। ফলে এক্ষেত্রে স্কুলের ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, করোনা মহামারিতে দেশে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বেকার হয়েছেন প্রায় তিন লক্ষ ষাট হাজার শিক্ষক-কর্মচারি। অন্যদিকে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল ঐক্য পরিষদ বলেছে, দুই লক্ষ প্রাইমারি শিক্ষক স্থায়ীভাবে পেশা ছেড়েছেন। আরো তিন লক্ষ শিক্ষক শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেবেন। এসব শিক্ষকদের অনেকেই এখন গার্মেন্টস কর্মী, সবজি বিক্রেতা, কাপড় বিক্রেতা, দোকানদার, কেউ কেউ পাঠাও চালক হিসেবেও কাজ করছেন। আবার অনেকেই চেষ্টা করেও কাজ জোগাড় করতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা স্কুলের ভাড়া ও অন্যান্য খরচ চালাতে না পেরে অনেক স্কুল বিক্রি করে দিতে চাইছেন।
এই বাস্তবতায় অনেক স্কুল মালিক আদাবরের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আমিনা বেগমের মতোই করে বাড়ি ভাড়ার খরচ কমাতে বাসা ছেড়ে পরিবার নিয়ে স্কুল ভবনে সংসার পেতে বাস করছেন। কেউ আবার ব্যয় কমানের জন্য স্কুল ভবনের কিছু অংশ অন্যদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন।
কল্যাণপুর ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক চায়ের দোকান দিয়ে বসেছেন। তিনি আর শিক্ষকতা পেশায় ফিরবেন না বলেও জানিয়েছেন। সরকার স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার ঘোষণার পর এ স্কুলটির কর্তৃপক্ষ ২১২ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। অভিভাবকদের কেউ জানিয়েছেন ছেলেকে তারা মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছেন, কেউ বলেছেন তিনি পরিবারে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। এখন স্কুল খুলে দেয়ার পর শিক্ষকও পাওয়া যাচ্ছে না।
করোনা মহামারির কারণে ১৭ মাস বন্ধ ছিল শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ দীর্ঘ সময়ে অনেক শিক্ষক মুদি দোকানি হয়েছেন। কেউ জড়িয়েছেন সবজি বেচাকেনায়। আরো অনেকেই পেশাও বদল করেছেন। করোনা মহামারীর দীর্ঘ সময়ে মাসে অনেক সেক্টর খোলা ও বন্ধ হয়েছে। এই সুযোগে অনেকেই সময়, ও সুযোগে ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু শিক্ষাই একমাত্র জায়গা যেখানে শুধুই তৈরি হয়েছে হতাশা।
বিবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও এক হাজারের মতো কিন্ডারগার্টেন ও স্কুল খোলে নি। স্কুলের শিক্ষকরা আদাবরের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমিনা বেগমের মতোই বলেছেন, মূলত আর্থিক অস্বচ্ছলতা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সংকটের কারণেই স্কুলগুলো বন্ধ রাখতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বন্ধ থাকার কারণ সম্পর্কে বলেন, ভাঙা বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলায় এখন এই সেক্টরটির কোনো কাজেই আসছে না। অবস্থা এমন তৈরি হয়েছে যে আমরা নতুন বছরকে মাথায় রেখেই আবার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংগ্রহে কাজ করতে হচ্ছে।
এক জরিপ থেকে জানা যায়, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর ৯৫ ভাগ ভাড়া বাসায় পরিচালিত হয়। কিন্ডারগার্টেনগুলোর ৬০ থেকে ৭০ ভাগই নারী শিক্ষক। এখানে যারা শিক্ষকতা করতেন তারা অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অথবা যারা উচ্চ শিক্ষা শেষ করেও ভালো চাকরি পান নি। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত টিউশন ফি দ্বারা পরিচালিত হয়। করোনার কারণে মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। একইসঙ্গে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভাড়া মিটিয়ে আবার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেপ্টেম্বরে স্কুল খোলার পর দেখা গেছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্তত ৮০ ভাগ কমেছে। নতুন ভর্তি শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। এর থেকে ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী বেতন পরিশোধ করেছে। তা দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান আয়া-দপ্তরি ও বৈদ্যুতিক ভাড়া মেটাচ্ছে। তবে শিক্ষদের বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে না।
কিন্ডারগার্টেন মালিকরা বলেছেন, সরকারি প্রণোদনা না পেলে তারা আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। কিন্ডারগার্টেন ও সমমান স্কুল রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী জানিয়েছেন, তারা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোর দৈন্যতা নিরসনে সরকারের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন। সমস্যা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। এছাড়াও মন্ত্রীপরিষদের বৈঠকে তাদের প্রস্তাব তোলা হয়েছে ও বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি আশ্বাস তারা পান নি।
করোনা মহামারীর শুরুর কয়েক কয়েক মাস পর থেকেই গেল বছরে কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষ সরকারি সহযোগিতা বলে আসছেন। কিন্তু সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব স্কুল নিয়ে এখনো তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।
কিন্ডারগার্টেন নামক শিশু বিদ্যালয় আমাদের সমাজে একটি বাস্তবতা। কিন্ডারগার্টেন নিয়ে বিতর্ক আছে। এখানকার পড়াশোনার ধরণ, সীমাবদ্ধ জায়গায় শিশুদের রেখে পড়ানো ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক আছে। তারামানে এই নয় যে, শিক্ষাজগতের বাস্তবতা আমরা এড়িয়ে যেতে পারব। না, এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এড়িয়ে যাওয়া উচিতও নয়। শিশুদের এ বিদ্যালয়গুলোর অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে? আজকাল পত্রপত্রিকায় এসব স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর বেশিরভাগই ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত হয়। অথবা একটু সচ্ছল অথচ বেকার কোনো ছেলেমেয়ে নিজের বাসার একটি ঘর নিয়েই হয়ত এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। করোনা মহামারির বন্ধের সময়টিতেও এদের বাড়ি ভাড়া ঠিকই দিতে হয়েছে। যদিও শিক্ষার্থীর বেতন আদায় হয় নি। অন্যান্য বিলও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্যিক হারে পরিশোধ করতে হয়েছে।
কিন্ডারগার্টেনের প্রাইভেট বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র বেতন পান। তাদের নির্ভরতা মূলত প্রাইভেট টিউশনিতে। এইটিও করোনার কারণে বন্ধ ছিল। এসব শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের বেতন যেমন পান নি, তেমনি প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ থাকায় সে আয়টুকুও বন্ধ ছিল। সেকারণে তাদের পক্ষে জীবন আর সংসার পরিচালন- দুই-ই কঠিন হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয় নি।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপদ্ধতিতে শিশুদের গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় সরকারের সহায়তা চাইছে সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছে, এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে সহায়তা না করলে দেশের প্রায় অর্ধকোটি মানুষের কাছে সরকারের শিক্ষাসংক্রান্ত সকল ইতিবাচক পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো সরকারের নীতিমালা বাস্তবায়নে কাজ করছে সেক্ষেত্রে আট লাখ শিক্ষক-কর্মচারীকে অসহায়ত্বে ঠেলে দেয়া মোটেও সমীচীন নয়। আমরা আশা করছি সরকার দ্রæত এর প্রতিকারে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসবেন।
প্রকাশকাল: অনুস্বর, অক্টোবর ২০২১।