খবরের কাগজে লিখেছে, এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারা বিশ্বের বনের অন্তত ৩০ শতাংশ গাছের প্রজাতি খুব শিগগিরই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ওক থেকে শুরু করে ম্যাগনোলিয়া, যে গাছগুলো পর্যাপ্ত কাঠ কিংবা ফুল দেয়, সেই গাছগুলো বিলুপ্ত হওয়ার পথে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তত ১৭ হাজার ৫০০ গাছের প্রজাতি ঝুঁকিতে আছে। গাছ বিলুপ্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকায় স্তন্যপায়ী, উভচর, সরীসৃপ প্রাণী এমনকি পাখিদের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়ছে। ৩০ শতাংশ গাছের প্রজাতি খুব শিগগিরই বিলুপ্ত হতে যাওয়ার কারণটি হলো এই গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। একদিনে কেটে ফেলে নি। শত শত বছর ধরে এসব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে।
পরিবেশের প্রধান উপাদান গাছ। গাছ না থাকলে আমাদের নিঃশ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ওষুধপত্র বন্ধ হয়ে যাবে। খাদ্য বন্ধ হয়ে যাবে। মাটি গ্রাস করবে সমুদ্র। বৃষ্টি হবে না। বৃষ্টির অভাবে মানুষের নৈমিত্তিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, হচ্ছেও তাই। আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটবে। বাতাস হয়ে যাবে দূষিত। তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল আর থাকবে না। চার ভাগই জল হয়ে যাবে। অথচ উন্নয়নের নামে আমরা সব গাছ কেটে ফেলছি। জলাশয় ভরে ফেলছি। তারপর সেখানে উঁচু উঁচু ভবন বানাচ্ছি। কেননা আমরা স্থাপত্য নির্মাণকে উন্নয়ন বলি। এইটি যে আমাদের নিজেদের বোঝাবুঝির সীমাবদ্ধতা সেটি আমরা মেনে নিতে রাজি নই। দুঃখজনক হলো, উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৃক্ষ নিধনের এই চিত্রটি আরও ভয়াবহ।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু দেশটি সত্যিকারভাবে উন্নয়নশীল হয়ে উঠবার অনেক আগে থেকেই সে যে উন্নয়নশীল দেশ, এইটি প্রচার করে আসছিল। অবশেষে স্বল্পোন্নত থেকে ২০১৮ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো এবং ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পক্ষে সুপারিশ করে। ফলে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ভোগ করতে শুরু করেছে।
তো উন্নয়নের নেশায় মত্ত বাংলাদেশেও চলছে গাছ কাটা উৎসব। খবরে কাগজে এসেছে, মৌলভীবাজারে বিদ্যুৎ লাইন বসাতে গিয়ে অন্তত তিন হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে! যারা কেটেছে তারা বলেছে, গাছ কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না! কদিন আগে বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রামের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) সিআরবিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণের সব আয়োজন প্রায় চূড়ান্ত করেছে। ইউনাইটেড হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিও করেছে রেলওয়ে। নগরবাসী সিআরবি জায়গাটিকে চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ বলে ডাকেন। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমলের চুন-সুরকির সিআরবি ভবনকে ঘিরে রয়েছে শতবর্ষী গাছগাছালি। সেসব কেটে রেলওয়ে হাসপাতাল বানাচ্ছে। হয়ত বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও মৌলভীবাজারের মতো করে ভাবছে, গাছ কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প তাদের হাতেও নেই।
ঢাকা শহরের মাটির সঙ্গে এখন গাছেরা সম্পর্ক হারিয়েছে। গাছ এখন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হয়েছে। মানুষের মতোই। ঢাকা শহরে উন্নয়ন চলছে। উন্নয়নের তোড়ে ঢাকা শহর থেকে সবুজ প্রায় নেই হয়ে গেছে। আগে শহরের বাড়িগুলোর সামনে একটু জায়গা ফাঁকা রাখবার রেওয়াজ ছিল। সেখানে বাড়ির লোকেরা সীমানা প্রাচীরের ভেতরে একটু বাগান করত। কিছু ফুলের, কয়টা সবজির গাছ থাকত। জায়গা একটু বড় হলে থাকত আম, জাম, কাঁঠাল গাছও। এই রেওয়াজ এখন উঠে গেছে। ঢাকা শহরে এখন আর বাড়ি তৈরি হয় না। বিশাল ভবন হয়। তাতে অনেকগুলো ফ্ল্যাট থাকে। তার কোনো কোনোটায় হয়ত থাকে এক চিলতে একটা বারান্দা। সেখানে টবেতে চলে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি। সকলেই নয়, কেউ কেউ পালন করে এ কর্মসূচি। কেউ কেউ আবার ছাদেও চলে যান। এছাড়া উপায়ও নেই। জায়গা কই! কিন্তু সেখানেও বাধে বিপত্তি। ছাদে টব বসাবার জায়গা নিয়ে ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের মধ্যে নির্মাণ হয় বৈরি সম্পর্ক।
ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ১১তম। কিন্তু আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হিসাবে এটিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘন শহর। শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। এই সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। দেশের সকল কিছুই রাজধানী কেন্দ্রিক। রাজধানীতে সকলেই থাকতে চায়। তাছাড়া দরকারি সকল কাজই রাজধানীতে। ফলে রাজধানীতে না থেকে উপায় নেই। এই মানুষদের জায়গা দিতে গালের দাড়ির ওপর রেজর চালানোর মতো করে ঢাকা শহরের গাছপালা নির্দয়ভাবে চেঁছে ফেলা হয়েছে। ফেলা হচ্ছে এখনও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে খাবারের দোকান বানানো হচ্ছে। নানান স্থাপনা তৈরির সময় কোনো গাছ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে, তা কেটে ফেলা হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় এসব উন্নয়ন কাজের জন্য কত গাছ কাটা হয়েছে বা কাটতে হবে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে সে হিসেব নেই। ১৯৯৮ সালে প্রকল্পটির শুরু থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কত গাছ কাটা হলো, সে তথ্যও কারো কাছে নেই। পরিবেশবিদ, নগরবিদ, প্রকৃতি-প্রেমীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। গাছ কেটে খাবারের দোকান বা অন্যান্য স্থাপনা তৈরির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, পরিকল্পিত সবুজায়নের অংশ হিসেবে ‘অপ্রয়োজনীয়’ গাছ কাটা হচ্ছে।
‘অপ্রয়োজনীয় গাছ’! হায়! গাছ নাকি অপ্রয়োজনীয়! প্রকল্পের এসব কর্তাব্যক্তিরা নাকি শিক্ষিত! বড় বড় ডিগ্রি অর্জনের পর চাকরিতে ঢুকেছেন। যোগ্যতা প্রমাণ করবার পর কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। এই যোগ্যতা প্রমাণ করা লোকগুলো এখন বলছে গাছ অপ্রয়োজনীয়!
২০১৬ সালে বিশ্বে পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪১.৭৬। সেটা ২০১৯ সালে নেমে স্কোর দাঁড়িয়েছে ২৯.৫৫-তে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একটি ঐতিহাসিক সম্পত্তি, সাংবিধানিকভাবে এটি রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। আমার ব্যক্তিগত তার মতামত হচ্ছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে যতটা সম্ভব অক্ষত রাখতে হবে। স্থাপনা হতেই পারে, তবে তা চারদিকে ছড়িয়ে করতে হবে। ঢাকা শহরের পার্ক ও গাছপালা রক্ষায় বিভিন্ন সময় তাঁরা মতামত দিয়েছেন। বেশিরভাগ সময়ই মতামতের ধার ধারে না।’
মুনতাসীর মামুনের মতো ব্যক্তির মতামতের ধার যদি না ধারে তাহলে আমরা যারা ‘আমজনতা’, তাদের কথা তো এইসব কুম্ভকর্ণেরা শুনতেই পাবে না। পায়ও নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রাচীন, বিশাল আর ইতিহাসের অংশ গাছগুলোকে কুম্ভকর্ণেরা কেটে ফেলেছে। গাছ কেটে জায়গা খালি করে সে জায়গায় আধুনিক খাবারের দোকান বানাচ্ছে। হাঁটাচলা করতে করতে যদি আপনার ক্ষুধা লাগে তো ওখানে দাঁড়িয়ে বার্গার কিনে খেয়ে ফেলতে পারবেন। চা-কফি-জুসও কিনে খেতে পারবেন। এইটিকে বলে নাগরিক সুবিধা। এই সুবিধা উন্নয়নের অংশ। এগুলো করে আমাদের উন্নয়নশীল দেশটিকে নাকি উন্নত করে ফেলা হচ্ছে। এই উন্নয়নকারী কর্তাব্যক্তিরা কেন বোঝেন না, বেঁচে থাকবার জন্যে ফুসফুস পূর্ণ করে যে বাতাস তারা বুকের ভেতরে টেনে নেন, গাছ না থাকলে সে বাতাস আর বেঁচে থাকবার উপাদান হয়ে থাকবে না। বিষ হয়ে যাবে। সে বাতাস তখন বাঁচিয়ে রাখবার বদলে সর্প দংশনের মতো দেহটি তার নীল করে দেবে।
পরিবেশ প্রাণী আর প্রাণকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়- এ কেমন উন্নয়ন! আমরা বুঝতে পারি না। আমরা সত্যিই বুঝতে পারি না।
প্রকাশকাল: অনুস্বর, সেপ্টেম্বর ২০২১।