আমেরিকায় বাংলাদেশি

0 comment 107 views

স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রে এসে উচ্চডিগ্রি নিয়ে দেশেই ফিরতেন। কমই থেকে যেতেন। স্বাধীনতার পর এ চিত্র পাল্টাতে থাকে। বেশিরভাগই এখানে এসে স্থায়ীভাবে থেকে যান। এর অন্যতম কারণ বেশি আয়, সহজ জীবনযাত্রা, সামাজিক-পেশাগত নিরাপত্তা ও সন্তানদের উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি।  ১৯৭১-পরবর্তী সময় থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৭৩-এ যে সংখ্যা ছিল ১৫৪, ১৯৭৬-এ ৫৯০, সে সংখ্যাটি ১৯৮০ সালে এসে দাঁড়ায় সাড়ে তিন হাজার জনে।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ইউএস সিআইএস, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশির সংখ্যা ১০ লক্ষ ৪২ হাজার ৭১০ জন। তবে বাংলাদেশি অভিবাসীদের একটা বড় অংশ ভোটারই হন নি। বছরের পর বছর ধরে কষ্টার্জিত অর্থ থেকে ট্যাক্স দেবার পরও এদেশের রাজনীতিতে তাদের কোনো কণ্ঠ নেই। কোনো অধিকার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী নাগরিক না হওয়া পর্যন্ত কেউ মিউনিসিপাল বা প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে না।

স্বাধীনতার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় (ডিভি লটারি, পারিবারিক কোটা, বিশেষ ক্যাটাগরি, বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভিসা ইত্যাদি) যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জন বাংলাদেশি। এছাড়া আরও ৭ লাখ ১৮ হাজার ২৬৬ জন এসেছেন ট্যুরিস্ট, ছাত্র, ব্যবসা, চিকিৎসা ইত্যাদি নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসায়। মেক্সিকো অথবা কানাডা সীমান্ত পথ পাড়ি দিয়ে আরো এসেছেন লাখ খানেক বাংলাদেশি। এর মধ্যে অনেকেই অ্যাসাইলামের পথ ধরে সিটিজেনশিপ পেয়েছেন। এছাড়া, নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় আগতদের বড় একটি অংশও পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি লাভের পথ বেয়ে সিটিজেনশিপ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্য থেকে গত বছর পর্যন্ত সিটিজেনশিপ গ্রহণকারীর সংখ্যা হলো দু’ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫৯৮।

২০১২ সালে বিশ্বের চিকিৎসা-বিজ্ঞান জগতে সেরা  ১০০ ব্যক্তিত্বের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলাদেশি-আমেরিকান ড. রায়ান সাদী। পরে লাইফ-সায়েন্স ব্যবস্থাপনায় বিশেষ পারদর্শিতার ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ক্যাথলিন সেবিলিয়াসের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হন।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আমেরিকান ফারাহ আহমেদ। তার বাবা ড. মাতলুব আহমেদ ও মা ড. ফেরদৌস আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। নানা ড. আব্দুল বাতেন খান বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি চিকিৎসকের সংখ্যা দু হাজারেরও বেশি। পেশাগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তাঁরা অনেকেই খুব ভালো অবস্থানে আছেন। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে তাঁরা সুনাম অর্জন করেছেন। বেশিরভাগই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। অল্পসংখ্যক মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনায় জড়িত।

বাংলাদেশের মার্কিন দুতাবাস জানিয়েছে, ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশি ৮ হাজার ৮৩৮ শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করেছেন। এর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী প্রেরণে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৭তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসগুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭৫ শতাংশই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত নিয়ে লেখাপড়া করছেন। তাদের মধ্যে ৪১ শতাংশের বেশি প্রকৌশল, প্রায় ১৯ শতাংশ গণিত/কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং ১৫ শতাংশের বেশি ভৌত বা জীববিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করছেন। প্রায় সাত শতাংশ পড়ছেন ব্যবসায়/ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। ছয় শতাংশ সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যনরত আছেন।

এ বছর মার্চে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্বোধন করা হয়েছে। নাম ইনোভেটিভ গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি। ওয়াশিংটন ডিসি সংলগ্ন ভার্জিনিয়ায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন প্রকৌশলী আবুবকর হানিপের প্রতিষ্ঠা করেছেন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে সম্প্রতি জো বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দফতরের ‘চিফ অব স্টাফ ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ফারাহ আহমেদ। এর আগে তিনি ‘সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেস-এর সিনিয়র পলিসি অ্যানালিস্ট এবং গ্রাহক আর্থিক সুরক্ষা ব্যুরোর (সিএফপিবি) চিফ অপারেটিং অফিসারের সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগে প্রায় হাজার সদস্য রয়েছেন, যাদের মূল শেকড় বাংলাদেশে। ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সাল, টানা তিনবার ‘কপ অব দ্য ইয়ার’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। গেল মে মাসে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে প্রথমবারের মতো নারী হিসেবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত  ফজিলাতুন নেসা নিয়োগ পেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসায় প্রথম বাংলাদেশি নারী মাহজাবীন হক। মাহজাবীন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। প্রথমে তিনি টেক্সাসে অবস্থিত নাসার জনসন মহাকাশ কেন্দ্রে ডাটা অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করেন। এরপর, তিনি মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন।

বাংলাদেশি গবেষক রুবাব খান। তিনি মহাকাশ সংস্থা নাসার স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) ফেলো। এ পর্যন্ত তিনি ৩৫টি গবেষণাপত্র লিখেছেন। এর মধ্যে ৯টিতে প্রধান লেখক হিসেবে ছিলেন। হিাবল, স্পিটজার, হার্শেল স্পেস টেলিস্কোপ ডাটার আলোকমতি এবং বহু তরঙ্গ দৈর্ঘ্য-সংক্রান্ত গবেষণায় জড়িত ছিলেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নেওয়া সফল বাংলাদেশিদের মাধ্যমে দেশের নানা উদ্যোগে সম্মিলিতভাবে অনেকভাবে সহায়তা দেওয়া সম্ভব। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতির প্রভাব এখানেও ব্যাপক। বাংলাদেশের অভিবাসীদের প্রায় প্রত্যেকেরই দেশে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। তাঁদের অনেক ধরনের দায়িত্ব পালন করার দক্ষতা রয়েছে।

এভাবে বলতে থাকলে ফুরাবে না। বাংলাদেশিরা আমেরিকায় এসে শুধু ট্যাক্সি চালায় বা গ্রোসারি শপে কাজ করেন, তা নয়। সকল পেশাতেই বাংলাদেশিদের উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে। কোথাও কোথাও ধ্রæবতারার মতোই জ্বলজ্বলে।

প্রকাশকাল: অনুস্বর, জুলাই ২০২১।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing