এটি একটি প্রতিযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্রেরই কোনো অঞ্চলে আয়োজিত হয়েছে।
বেশ বড় একটা ম্যাট্রেস বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ম্যাট্রেসের এক প্রান্তে ছয় সাতজন শিশু। শিশুগুলোর বয়স খুব বেশি হলে ছয় মাস হবে। তারা এখনও হাঁটতে পারার মতো বড় হয়ে ওঠে নি ওরা। হামাগুড়ি দিয়ে চলতে পারে। একারণেই ম্যাট্রেস দেয়া হয়েছে। এর ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চললে এই শিশুদের আঘাত লাগবে না। ব্যথা পাবে না তারা। শিশুদের পিতারা তাদের পেছনে বসে। তারা চিৎকার আর নানা ভঙ্গি করছেন। উৎসাহ দিচ্ছেন আপন সন্তানদের হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে। ম্যাট্রেসের অপরপ্রান্তে আছে বাচ্চাদের মায়েরা। তাদের হাতে শিশুদের ঝুনঝুনি কিংবা খেলনা। তারাও চেঁচাচ্ছেন। প্রাণপণে ঝুনঝুনি বাজাচ্ছেন তারা। হাতের খেলনা নাড়ছেন। প্রলুব্ধ করতে চাইছেন সন্তানকে যেন সে ম্যাট্রেসের ও প্রান্ত থেকে ছুটে মায়ের কাছে চলে আসে। চলে আসতে পারলেই শিশুটি পেয়ে যাবে নিজের পছন্দের খেলনাটি। পেয়ে যাবে মায়ের কোল। পাবে মায়ের আদর আর নিরাপত্তা।
কিন্তু শিশুরা ছুটছে না। ম্যাট্রেসের সরল রেখা ধরে ছুটতে রাজি নয় তারা। তারা বসে থেকে এদিক ওদিক তাকায়। উদাস নয়নে আকাশ দেখে। কখনো দৃষ্টিতে খুব বিরক্ত নিয়ে চায় বাবার পানে। আজকে এই ভদ্রলোক বড় যন্ত্রণা করছেন। সম্ভবত বাবা নামক ভদ্রলোকটির যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে দুয়েকজন শিশু হামাগুড়ি দিতে শুরু করল।
আচ্ছা, জীবন কি এমন? বোদ্ধারা তাই বলেন। বলেন, জীবনের প্রতিযোগিতায় নাকি মানুষ ছুটতেই থাকে। ক্লান্তিহীন ছুটে চলাই জীবন। নচিকতা গান বানিয়েছেন, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন/শুধু জীবনের কথা বলাই জীবন।’
জীবনের পথ চলতে থেমে যাওয়া যাবে না। থেমে গেলেই জীবনের অবসান। অবসানের আগে নিজে থেকে থেমে যাওয়া মানে পরাজয়। পরাজিত হয় ব্যক্তি। মানুষ পরাজিত হয় না। অবসানের কথা তাই ব্যক্তিমানুষেই বলে। মানুষ বলে জীবনের কথা। জীবনকে সুন্দর করতে, জীবনকে গড়তে মানুষ তাই ছুটে বেড়ায় বিশ্বময়। জীবনে জীবনকে নিয়ে ছুটে যে চলতে হয়, সে শিক্ষাটিও মানুষ ছড়িয়ে দেয় প্রজন্মান্তরে। বলে, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। এও জানে সন্তানকে দুধেভাতে থাকতে হলে তাকে ছুটে চলবার যোগ্য করে গড়তে হয়।
কিন্তু সন্তান তো। শিশু সে। আদুরে বড়। সে প্রতিযোগিতায় ছুটতে চায় না। প্রকৃতি দেখতে চায়। উদাস হতে চায়। উদাস হয়ে আকাশ দেখতে চায়। শেষে আমাদের যন্ত্রণায় হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করে। তবে এই চলবার লক্ষ্য তার প্রান্তে বাজতে থাকা ঝুনঝুনি খেলনা। অথবা মায়ের মতো আদর। সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়।
আমিও প্রকৃতি দেখতে ভালোবাসতাম। উদাস হয়ে আকাশ দেখতাম। কিন্তু শুধু জীবনের কথা বলাই যে জীবন। জীবনের কথা বলবার একটাই নিয়ম- অন্তবিহীন পথে নেমে ছুটে চলতে হবে। আমিও অন্তবিহীন পথে নেমেছি। হামাগুড়িতে চলতে শুরু করেছি। হামাগুড়িতে চলতে চলতে একদিন চলে এসেছি এই নিউ ইয়র্ক শহরে।
এ শহরে জীবনের খুব গতি। বসে থাকবার নিয়ম নেই। উপায়ও নেই। ছুটে চলবার পথটা বন্ধুর বড়। রূঢ়। নিউ ইয়র্কের বন্ধুর পথ ধরে ছুটে চলতে থাকি। হাঁটু আমার বিক্ষত হয়। হাতের তালুতে রক্ত ঝরে। তার ব্যথা ছড়ায় বুক জুড়ে। ছুটে চলা সঙ্গী মানুষদের অদ্ভুত গাম্ভীর্য দেখে অন্তরে বিস্ময় ছাতা মেলে। আমার মনে পড়ে নচিকেতার গান, ‘যে মেয়েটা রোজ রাতে, বদলায় হাতে হাতে, তার অভিশাপ নিয়ে চলাই জীবন।’
আমি বিচলিত হই না। চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলা অব্যাহত রাখি। চলতে চলতে আরও মানুষ পাই। এরা প্রশান্তির মানুষ। প্রশান্তির এই মানুষেরা বিক্ষত হাঁটুর জন্যে ওষুধ এগিয়ে দেন। বন্ধুর পথ চলতে এগিয়ে দেন মসৃণ ম্যাট্রেস। তাদের আন্তরিকতা আমায় আপ্লæত করে। অন্তরে বিস্ময়ের বৃষ্টি ঝরে। আমি মাথা নুইয়ে তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
দেশকণ্ঠ, জুলাই ২০২১।