আফগানিস্তান ও আমেরিকা: শুরু থেকে শুরু

0 comment 62 views

মোহাম্মদ জাহির শাহ ছিলেন আফগানিস্তানের ইতিহাসে শেষ রাজা। পাশতুন সম্প্রদায়ের এ ক্ষমতাধর নেতার জন্ম ১৯১৪ সালের ১৫ অক্টোবর আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। ১৯৩৩ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে জাহির শাহ রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেন। দীর্ঘ ৩০ বছর রাজ্য পরিচালনায় তেমন কোনও অগ্রগতি দেখাতে পারেন নি তিনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে ১৯৩৪ সালে তার নেতৃত্বে আফগানিস্তান লিগ অব নেশনসের সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি চোখের চিকিৎসা করাতে ইতালি যান। তখন চাচাত ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ দাউদ খান ক্ষমতা দখল করেন। দাউদ খান আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

২০০২ সালের এপ্রিলে আফগানিস্তান যখন তালেবানদের শাসনে চলে যায়, তখন পার্লামেন্ট লয়াজিরগা চালু করতে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তবে মার্কিন বাহিনীর হাতে তালেবানদের পতন হলে দেশের প্রধান হিসেবে শাসন ব্যবস্থায় ফিরে আসতে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি আর রাজত্ব চাই না এবং লয়াজিরগার আদর্শে দেশ পরিচালনা করব। দেশের মানুষ আমাকে বাবা বলে ডাকে, এটাই আমার বড় পাওয়া।’ তবে মার্কিনিদের প্রিয় হামিদ কারজাই ক্ষমতা গ্রহণ করলে তার স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। মোহাম্মদ জহির শাহ ২০০৭ সালের ২৩ জুলাই মারা যান।

রাজা জাহির শাহের সময়টিতে আফগানিস্তান একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে পরিণত হয়েছিল। ছিল সামাজিক অধিকার, ছিল নারী স্বাধীনতা এবং গুরুত্ব পেয়েছিল ভোটাধিকার। দাউদ খানের সময়েও এসব গুরুত্ব অক্ষুন্ন ছিল। ১৯৭৮ সালে নুর মহম্মদ তারাকি দাউদ খানের সরকারের পতন ঘটিয়ে আফগানিস্তানে কমিউনিজম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর দেশটিতে ভূমি সংস্কার করা হয়, নারীদের রাজনীতিতে যুক্ত করা হয়, জোর করে নারীদের বিয়ে দেওয়া বন্ধ করা হয়। কিন্তু আফগানিস্তানের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এই উদারপন্থী পরিবর্তন কট্টরপন্থীরা মেনে নেয় না। কিন্তু তারাকি খুব কঠোরভাবে কট্টরপন্থীদের দমন করেন। তখন কট্টরপন্থীদের সমর্থনে তারাকির সহকারী হাফিজুল্লা আমিন তারাকিকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখল করে। তারাকি হত্যায় রাশিয়া বিচলিত হয়ে ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং হাফিজুল্লা আমিনকে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে হত্যা করে।

১৯৭৯ সালটা মধ্য এশিয়ার ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সঙ্গে এই বছরেই আমেরিকার আজ্ঞাবহ সরকারের পতন ঘটিয়ে ইরানে ঘটেছে ইসলামিক রেভ্যুলেশন। ইরানের পাশের দেশ আফগানিস্তান, সেখানে সোভিয়েত প্রভাব ছিল আমেরিকান সরকারের দুর্ভাবনা। কেননা জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসির পর পাকিস্তানের সঙ্গেও আমেরিকার স¤পর্কের অবনতি হয়েছে। আমেরিকার সেসময়ের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইলেন। সেই সঙ্গে তিনি তৃতীয় বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে সিআইএর সহযোগিতা চাইলেন।

আফগানিস্তানের লাল ফৌজকে প্রতিহত করতে তৈরি হলো অপারেশন সাইক্লোন। এটি ছিল বিশ্ব ইতিহাসের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে ব্যয়বহুল গোপন অপারেশন। এই অপারেশনের প্রধান ছিলেন টেক্সাসের ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান চার্লি উইলসন, সিআইএর প্যারামিলিটারি অফিসার মাইকেল ভাইকার্স এবং সিআইএর আঞ্চলিক প্রধান গাস্ট অ্যাভ্রাকোটোস। এদের প্রধান স্ট্র্যাটেজি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আফগান মুজাহিদিনদের অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষিত করে তোলা। আমেরিকার নাম যেন এর সঙ্গে না জড়ায় তার জন্য নেওয়া হয়েছিল বিশেষ ব্যবস্থা।

১৯৭৩ সালের চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েলের হাতে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দখল করা বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার। সিআইএর মধ্যস্থতায় কায়রোয় এক বৈঠকে ঠিক হলো ইসরায়েল-সোভিয়েতের এসব অস্ত্র গোপনে মিশরকে বিক্রি করবে। অথচ কয়েক বছর আগে মিশরের বিরুদ্ধেই ইসরায়েল যুদ্ধ করেছিল। মিশর থেকে সেই অস্ত্র চলে গেল পাকিস্তানে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল চার্লি উইলসন ও তার বান্ধবী জোয়ান হেরিংয়ের। অস্ত্রের বন্টন এবং মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে আমেরিকা স¤পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল পাকিস্তানের ওপর। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের দায়িত্ব ছিল অর্থ ও অস্ত্র বন্টন থেকে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব।

১৯৮৫ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ঘোষণা করলেন বিশ্বে যারাই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধীতা করবে আমেরিকা তাকেই সমর্থন করবে। এই ঘোষণার পর আর আমেরিকার গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজন ফুরাল এবং তারা সরাসরি মুজাহিদিনদের যুদ্ধের রসদ সরবরাহ করতে লাগল। এই মুজাহিদিনদের মধ্যে যেমন ছিল পঞ্জশিরের আহমেদ শাহ মাসুদ, তেমন ছিল পরবর্তীতে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বুরহানুদ্দীন রাব্বানী, ছিল তালেবান নেতা সিরাজউদ্দীন হাক্কানির বাবা জালাল উদ্দীন হাক্কানি। সিআইএর অন্যতম প্রধান সম্পদ ছিল এই হাক্কানি। আমেরিকা তাকে বিপুল অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে। হাক্কানি সেসময় ওসামা বিন লাদেনকে নিরাপত্তা দেয় এবং আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। কংগ্রেসম্যান চার্লি উইলসন হাক্কানির কাজে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন ‘গুডনেস পারসোনাফাইড’। এছাড়াও সিআইএ ডিরেক্টর উইলিয়াম কেসি বহুবার পাকিস্তানে গিয়ে মুজাহিদিনদের ট্রেনিং পরিদর্শন করেন। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান হোয়াইট হাউসে মুজাহিদিনদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

১৯৮৬ সালে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন নাজিবুল্লা। আফগানিস্তান কমিউনিস্ট শাসিত একটি দেশ। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বেরিয়ে যায় আফগানিস্তান থেকে। কিন্তু ১৯৮৯ পরবর্তী সময়েও আমেরিকা অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে মুজাহিদিনদের সাহায্য করে আসছিল। মুজাহিদিনরা নাজিবুল্লাকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে ১৯৯২ সালে। ১৯৯৪ সালে এই মুজাহিদিনদের একটি অংশ প্রতিষ্ঠা করল তালেবান। এরাই ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তান দখল করে প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাকে মেরে রাজপথে প্রকাশ্যে ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। এরপরের ইতিহাস আফগানিস্তানে তালেবানদের অত্যাচার নির্যাতন আর অন্ধকার নামিয়ে আনবার ইতিহাস। তারপর তো ঘটল ৯/১১-এর হামলা, দীর্ঘ বিশ বছরের যুদ্ধ।

২০২০ সালের দোহা চুক্তির ভিত্তিতে আমেরিকা তার সেনাবাহিনী সরিয়ে নিল। এর তিন মাসের মধ্যেই তালেবানরা আবার কাবুল দখল করল। গেল তিরিশ বছরে ভেঙে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। নতুন শক্তি হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে চীন। ২০২১ এর আগস্টে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নস কাবুলে গিয়ে তালেবানের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন। সে বৈঠকে কি নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেটি গণমাধ্যম জানে না। চীন বা রাশিয়াও তালেবানের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছে। কেন সমর্থন দিল সেটিও গণমাধ্যম জানতে পারে নি। আফগানিস্তান হলো অমূল্য খনিজ সম্পদের এক বিপুল ভাণ্ডার।

২০১০ সালে আমেরিকার এক গবেষণা থেকে জানা যায়, আফগানিস্তানে রেয়ার আর্থ মিনারেলস নামে দুর্লভ খনিজ পদার্থ রয়েছে। এই খনিজের দাম বর্তমান বাজারে প্রায় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে আছে তামা, সোনা ও অন্যান্য খনিজ। সব মিলিয়ে যার দাম দাঁড়ায় তিন ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। এতদিন পর্যন্ত আমেরিকা সেখানে উপস্থিত থাকলেও তালেবানি সন্ত্রাস ও অস্থিরতার কারণে এই খনিজ সম্পদে এখনও কারও হাত পড়ে নি। আফগানিস্তানের লিথিয়ামের ভাণ্ডারকে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা সৌদি আরবের তেলের ভাণ্ডারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অন্যদিকে বিশ্বের বৃহত্তম দুর্লভ খনিজ উৎপাদনকারী দেশ হলো চীন। পৃথিবীর ৬০ ভাগ দুর্লভ খনিজ রয়েছে চীনে।

আজকের এই প্রযুক্তির পৃথিবীতে অন্যতম মূল্যবান ও সর্বোচ্চ চাহিদার দ্রব্য হলো এই রেয়ার আর্থ মিনারেলস। আমেরিকার ভবিষ্যৎ টেকনোলজিকাল বিকাশে এই খনিজ খুব দরকার। দীর্ঘদিন আমেরিকার এই খনিজের চাহিদা পূরণ করে এসেছে ল্যাটিন আমেরিকার চিলি, পেরু, বলিভিয়া। কিন্তু সম্প্রতি পেরু ও বলিভিয়ায় বামপন্থী সোশালিস্ট পার্টি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার ফলে এর জোগানে ভাটা পড়েছে। ফলে এই চাহিদা পূরণে আমেরিকার এখন উৎস দরকার। সেকারণে আফগানিস্তানের দিকে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর তো বটেই, তার সঙ্গে চীন এবং রাশিয়ারও দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতেই পারে। আফগানিস্তানে যদি রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল হলে এসব খনিজ উত্তোলন সম্ভব হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে তালেবানদের দরকার অর্থ। আর সে অর্থ জোন দিতে পারে আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ।

নারীর স্বাধীনতা কিংবা মানবাধিকার তো সৌদি আরবেও নেই, কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে ব্যবসা করতে কোনও দেশই কখনও আপত্তি করে নি। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বে ব্যবসাটাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ। উইঘুর নিয়ে কথা না বললেই চীন সন্তুষ্ট। আর আমেরিকার তো আফগানিস্তানের খনিজ সবচেয়ে বেশি দরকার। দরকার চীনকে দমিয়ে রাখাটাও।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing