অর্থবিত্ত এবং আমি

0 comment 82 views

শুরুতেই বলে দেওয়া দরকার, টাকা সকলে উপার্জন করতে পারেন না। দ্বিতীয় কথা হলো, টাকা সকলে যথাযথ খরচ করতেও জানেন না। ফলে টাকা আয় করতে পারা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তারচেয়েও অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আয় করা টাকাটি খরচ করাটাও জানতে হয়। মানে হলো টাকাপয়সা আয় করতে পারাটা মুখ্য নয়, মুখ্য আয় করা টাকাপয়সা খরচ করতে পারা। সোজা কথাটা হোল, আপনি আপনার উপার্জিত অর্থ সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ, লগ্নি কিংবা খরচ করতে না পারেন, তাহলে আপনি আপনারই উপার্জিত অর্থের যোগ্য নন/

খুব কঠিন হয়ে গেল কি কথাগুলো? শুনতে খুব খারাপ লাগল। তাহলে ক্ষমা করবেন। আমি নিরুপায়। এর চেয়ে সহজ করে বলবার উপায়টি আমার অন্তত এই মুহূর্তে জানা নেই।

বিষয়টা হলো সকলেরই নিজের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের একটা সামঞ্জস্য রেখে তার এবং তার পরিবারের জন্য একটি বাজেট করতে হয়, এইটি জরুরি। আপনি আপনার উপার্জিত অর্থ থেকে কতটুকু খরচ করবেন আর কতটা জমিয়ে রাখবেন অথবা কতটুকু পরিবারের বাইরের মানুষদের জন্য খরচ করবেন সবকিছুরই একটা পরিকল্পনা থাকা চাই। এটাকেই অর্থনীতির ভাষায় বাজেট বলা হয়। শুরুতে, যখন আপনি অল্প বয়সি তখন হয়ত পরিকল্পিত বাজেট অনুসরণ করে চলা সম্ভব হবে না, এইটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কেননা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার উপার্জন বাড়বে- এইটিও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একসময় দেখা যাবে চিকিৎসা খাত ছাড়া আপনার আর কোনো খরচ নেই!

ফলে দেখতে পাচ্ছেন আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ব্যয় কমে আসছে। কিন্তু তখন আপনার বয়স বেড়ে গেছে। ধরুন তারুণ্যে আপনার ইচ্ছা ছিল এভারেস্টে চড়বেন, কিন্তু অর্থনৈতিক অপ্রুতুলতা আপনার সে স্বপ্নকে পূরণ করতে দেয় নি। কিন্তু এখন এই বয়সে আসবার পর আপনি জানেন অর্থনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। আপনি ইচ্ছা করলেই তারুণ্যের সে স্বপ্নটিকে বাস্তবতায় রূপ দিতে পারেন।

সত্যিই কি পারেন? অর্থ উপার্জনকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে আপনি এমন ভাবে জীবনকে অতিবাহিত করেছেন যে আপনি কখনও ভাবতেও পারেন নি অর্থ ছাড়াও জীবনে আরও আরও অনেক কিছু অর্থের চেয়েও জরুরি থাকতে পারে। কেননা এখন আপনার বয়সই আপনার তারুণ্যের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করবার প্রধান অন্তরায়। আপনার বয়স আপনাকে এভারেস্টে চড়বার অনুমতি দিতে রাজি নয়। এমনকি সে আপনার খাবারের দিকেও কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জানিয়ে দিচ্ছে আপনি কি খেতে পারবেন আর পারবেন না। আরও মজার ব্যাপার হলো, তারুণ্যে যেসব পোশাক আপনাকে প্রবল আকর্ষণ করত কিন্তু অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে আপনি সেগুলো কিনে পরতে পারতেন না, এখন খুব অবলীলায় সেসব ডজন ডজন কিনে ফেলবার ক্ষমতা থাকলেও আপনি কিনবেন না, কেননা আপনি জানেন ওসব এখন আপনাতে যায় না। আপনি জানেন আগে ওসব পোশাক পরলে দৃষ্টিতে ঈর্ষা নিয়ে যারা আপনার দিকে তাকাত, এখন তারাই বিষম কৌতুকে এর ওর গায়ে লুটিয়ে পরবে।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? জীবনের বাতিলের খাতায় কি আপনার নাম উঠে গেছে। এমনটা যদি ভেবে থাকেন তবে খুব করে ভুল ভাবছেন। জীবনের এই পর্যায়ে এসেও আপনার অনেক অনেক কিছু করবার আছে। আপনি এ পর্যন্ত যেসব কাজ করেছেন, এই জায়গাতে এসে তার মূল্যায়ন পাবেন। আপনার ভালো ভালো কাজের প্রশংসা পাবেন, পাবেন শ্রদ্ধা, পাবেন সন্মাননা।

একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমাকে অনেকের সঙ্গেই বসতে হয়, আলাপ করতে হয়। কিন্তু বস্তুত আমি তো একটা আড্ডাবাজ মানুষ। ফলে কাজের কথাবার্তার সঙ্গে সঙ্গে আমি কাজের বাইরেও নানান কথাবার্তা বলি। ওই যে কথায় আছে না, মানুষ তার নিজেকে অতিক্রম করতে পারেন না। আমি বোধহয় তারই শিকার। তবে এ আমার দুঃখ নয়, এ আমার আনন্দ।

একবার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোকের বয়স পঁচাত্তর বছর। তিনি জানালেন, গুলশানে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির কাজে হাত দিচ্ছেন। চকিতে আমার ভাবনা এল, ‘তবে আমি কেন ভাবই সময় শেষ!’ পঁচাত্তর বছর বয়সি একজন মানুষ যদি ডুপ্লেক্স বাড়ির কাজ শুরু করে সেখানে জীবন যাপনের স্বপ্নে বিভোর হতে পারেন তাহলে তো আমি এখনও বিশ বছরের যুবক! আমি কেন স্বপ্নহারা হবো। আমি কেন হাল ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে মৃত্যু দূতের প্রতীক্ষায় বসে থাকব!

মৃত্যু তো অবধারিত। সে আসবেই। আমাকেও যেতেই হবে। আমাকে একলা নয়, আমাকে, একে, ওকে, তাকে- সকলকেই। যারা এই কথাটি জানে, বিশ্বাস করে, মৃত্যুভয় তো তাদের জন্যে নয়। যারা জানে না, মানে না, তাদের জন্যে বটে।

কিছু কিছু মানুষ ধরেই নেন তারা অমর। তারা ধনসম্পদ আর টাকার নেশায় এতটাই বুঁদ থাকেন যে মৃত্যু তো দূর, তাদের আশপাশেই বা কি চলছে, কে কি বলছে কিংবা ভাবছে সেকথা আমূল ভুলে যান। তাদের দিকে তাকালে মৃত্যুকেই অসহায় মনে হয়। অথচ তাদের সন্তান কিংবা পরিবার যে তার টাকা ছাড়া চলবে না ব্যাপারটা এমনও নয়। তবু তাদের সে কি প্রবল টাকার টাকার নেশা! সে টাকা বৈধ না অবৈধ ওতে তাদের কিছু যায় আসে না। তাঁরা নিজেদেরকে শেয়ালের মতো ধূর্ত আর বিড়ালের মতো চতুর ভাবতে পছন্দ করেন। জীবনের সাত আটটি দশক পেরিয়েও, কবরের শেষ রেখায় পৌঁছেও এরা দুর্নীতি করেন, অসৎ পথে টাকা উপার্জন করতে বেপরোয়া হন।

অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা গেচ্ছে তার সম্পদ অলসভাবে বছরের পর বছর ব্যাংকে পড়ে রয়েছে, অথচ মালিক সেই কবে মরে গেছে! কবর খুঁড়লে হয়ত হাড়গোড় পাওয়া যাবে কিংবা সেও পাওয়া যাবে না। সে যে উত্তরাধিকার রেখে গেছে তার হয়ত এই টাকার দরকারও নেই। অথবা সে যে জানেও ব্যাংকে গচ্ছিত তার পূর্বপুরুষের সম্পদ সম্পর্কে। ফলে কেউ হয়ত খোঁজ নিতেও যায় না।

টাকা একটা নেশার মতো। যারা শুধু টাকা উপার্জনকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে ফেলে, তারা আসলে টাকাটাই জোগায়, সে টাকা খরচ করে না। অথবা বলতে পারেন সে টাকা খরচ করবার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। একসময় তারা বৃদ্ধ হন, কিন্তু অনভ্যাসের কারণে ও বয়সেও জমানো টাকা খরচ করেন না। টাকা নিয়ে সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, আশঙ্কায় থাকেন- এই বুঝি কেউ এসে মেরে দিল সব!

সেজন্যেই বলছিলাম, টাকা উপার্জন করতে পারার পাশাপাশি জানতে হয় টাকাটা কিভাবে ব্যয় করতে হবে। শিখতে হয় কোন্‌ খাতে কিভাবে খরচ করা দরকার। মনে রাখতে হবে টাকা খরচ মানে অপচয় কিংবা অপব্যবহার নয়। এই অপচয় ও অপব্যবহারের প্রধান অংশটি খরচ হয় পুনরায় বিয়ে করে নতুবা মদ আর বাইজীর সন্ধানে।

মোগল শাসনামলে রাজধানী ঢাকা যখন জাহাঙ্গীরনগর, তখন এখানে সঙ্গীত আর নৃত্যের কেন্দ্রটি খুব প্রসারিত হয়েছিল। ইসলাম খানের দরবারে ১২০০ কাঞ্চনী বাঈজি শোভা পেত। যাদের পেশা নাচ-গান। এ থেকে অনুমিত হয়, ইসলাম খানের ঢাকা আসার আগেও এখানে গান-বাজনার ব্যাপক চর্চা ছিল। তা না হলে ১২০০ কাঞ্চনীর এত অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর দরবারে হাজির হওয়া অসম্ভব হতো। কাঞ্চনী ছাড়াও তাঁর দরবারে ছিল লুলি, হোরকানি ও ডোমনি—এরা সবাই নাচনী মেয়ে। এদের জন্য তাঁর বার্ষিক খরচ হতো ৮০ হাজার টাকা।

রাজধানী ঢাকার বয়স চারশ’ বছর। জাহাঙ্গীরনগর তো আরও অনেক অনেক পুরনো। ধরুন পাচশ’ বছর। সে সময়ের ৮০ হাজার টাকার মান এখন কত হতে পারে কেউ বলতে পারেন? আমার অত জ্ঞান নেই। তবে এটুকু জানি, মোগল আমলে ১৬শ’ শতাব্দিতে বাংলার একজন বিখ্যাত সুবেদার বা প্রাদেশিক শাসক শায়েস্তা খাঁর (১৬৫৮–১৬৬৯) আমলে এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। বাংলার আরেক নবাব সুজাউদ্দীন খানের আমলেও (১৭২৭-৩৯) টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। তারমানে বাঈজির পেছনে যা খরচ হতো তা দিয়ে ৬শ’ চল্লিশ মণ চাল কেনা যেত। বেশি ভেতরে না যাই, শুধু ধারণা না থাকার কারণে দুটি প্রশ্ন বলি, ৬শ’ ৪০ মণ চাল দিয়ে কয়টি পরিবার কতদিন থালা ভরতি ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেতে পারে- কেউ কি জানাতে পারেন? আর ৬শ’ ৪০ মণ চালের বর্তমান বাজার মূল্য কত?

ভাবুন তো, মোগলরা নারী ও মাদকমুক্ত হয়ে আন্তরিকভাবে দেশ পরিচালনা করতেন তাহলে আজকে আমাদের অবস্থান কি হতো?

সমস্যা হলো একালেও ধনী লোকেদের একটি বড় অংশ ভাবেন সম্পদশালী হলেই বুঝি ব্রেন্ডড ক্লথ, জুতা আর চারিপাশে রূপবতী নারীদের হট্টগোল। অথচ যারা অনেক যারা অধ্যাবসায় করে আজকে বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন তাদের জীবন কেবলই নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলায় আবদ্ধ।

দুঃখজনক হলেও সত্যটি হলো আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের ফিনেন্সিয়াল লিটারেসি বা অর্থনৈতিক জ্ঞানের বড় অভাব। তারা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ঋণ, বাজেট , ফিক্সড ডিপোজিট, ভবিষ্যৎ সেফটির জন্য জমিয়ে রাখা, ইনস্যুরেন্স, যে কোন বিনিয়োগ কিংবা পুঁজি বাজার সম্বন্ধে ন্যুনতম জ্ঞানও রাখে না বলে কেবলই পরাস্ত হয়। অথচ এ বিষয়গুলো স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের সাধারণ বা প্রাথমিক জ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া স্বাভাবিক ছিল।

আজকে দেখুন, বেশির ভাগ পরিবারে বাজেট নেই। আয়ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা নেই। তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। যাদের সামর্থ্য আছে তাঁদের অনেকের মাঝেও ভবিষ্যৎ কঠিন সময়ের সঞ্চয়ের কোনো প্রবণতা নেই। তাদের নিয়তি যেন সামাজিক প্রতিযোগিতার কবলে পরে কেবলই সর্বস্বান্ত হওয়া। কঠিন সময় এলে এরাই বিপদে পরেন।

অন্যদিকে সমাজে অবৈধ টাকার ওড়াউড়িতে সাধারণের জীবন ওষ্ঠাগত। তখন তাদের কাছে যেনতেন উপায়ে টাকা উপার্জন করতে পারাটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তাদের কোনো আদর্শ নেই, নেই কোনো নৈতিকতা নেই, কিন্তু মুখে কেবলই কথার ফুলঝুড়ি। আর অসৎ লোকদের দৃশ্যমান কোনো উপার্জন না থাকলেওম আছে সম্পদের পাহাড়।

আমার কেবলই মনে হয় আমরা বোধহয় ক্রমাগত একটি লাজ-লজ্জাহীন স্বার্থপর জাতিতে পরিণত হয়ে উঠছি।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing