আজকে আমি বাবা হলাম।
শুনে অবাক হলেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফৌজিয়ার যেদিন জন্ম হলো সেদিনই তো আসলে বাবা হলাম। কিন্তু বাবা হওয়ার অনুভূতিটা আজই যেন অনুভব করছি। আপনি হয়ত বলবেন নতুন করে অনুভব করছি। কিন্তু সেটি সঠিক নয়। আমার সত্যিই মনে হচ্ছে আজ আমি বাবা হয়েছি।
১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে যখন ফৌজিয়াকে আমার কোলে তুলে দেওয়া হলো, সেদিন অবাক বিস্ময় ছাড়া বস্তুত আমার আর কোনো অনুভূতি ছিল না। কাপড়ে প্যাঁচানো এইটুকু একটা মানবশিশু। আমার দু হাতের তালুতে কি ভীষণ নির্ভরতায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! সামান্য অসুবিধা হলে নড়েচড়ে আরাম খুঁজে নিচ্ছে। তাতে যদি আরাম না হয় তবে সুতীব্র চিৎকারে প্রতিবাদ ও দাবি জানাচ্ছে! আমি বিমূঢ় হয়ে সে শিশুকে দেখতে থাকি।
তারপর শিশুটি একটু একটু করে বড় হতে থাকে। আছাড় খেয়ে খেয়ে এক পা দু পা করে হাঁটতে শেখে। আমাকে বাবা ডাকতে থাকে। আমিও পরম মমতায় ঔরসজাত সন্তানকে বড় করে তুলতে থাকি। তারপর একদিন স্কুলে ভর্তি হলো ফৌজিয়া। একে একে ক্লাসগুলো ডিঙাতে থাকল আর বড় হতে লাগল। স্কুলের ক্লাস পার হওয়ার হিসাবটা রাখলেও আমি আমার মেয়েটার বড় হওয়া বুঝতে পারি না। কি করে পারব! বাবা-মায়ের কাছে ছেলেমেয়েরা কখনও বড় হয়!
তারপর একদিন এসএসসি শেষ করে স্কুল শেষ করল ফৌজিয়া। আর তখনই অদ্ভুত এক বায়না ধরলো মেয়েটা- সে আমেরিকা যাবে! একাই! স্নেহ সবসময় নিম্নগামী আমি নিষেধ করলেও তাতে কোনো জোর ছিল না। একদিন সত্যি সত্যিই সে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সেবার দশটা দিন ফৌজিয়া বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরে বেরিয়েছে। সে দশটা দিন আমি একটি রাতের জন্যেও ঘুমোতে পারি নি। কেমন একটা অস্থিরতায় কাটত সারাটা দিন আর রাত।
এই ফৌজিয়া আজ পঁচিশ বছরের তরুণী। লেখাপড়াও শেষ করেছে। আজ ফৌজিয়াকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। ফৌজিয়ার বিয়ে হয়ে যাবে- এই বাস্তবতা সামনে আসতে আমি বাবা হয়ে গেলাম। পঁচিশ বছর আগে যে অনুভূতিটি আসার কথা ছিল, সেটি এল পঁচিশ বছর পর।
ফৌজিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে সামাজিক নিয়মে ওকে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে বরের বাড়ি। না, সে বাড়ি খুব দূরে নয় নিজের বাড়ি থেকে। আর নিজের বাড়ি তো নিজেরই থাকবে আজীবন। কিন্তু ও তো আর আগের মতো এ বাড়িতে থাকবে না। এই ভাবনা আমাকে নতুন করে অস্থির করে তুলল। এই অস্থিরতা কাল সারাটা রাত আমাকে ঘুমোতে দেয় নি। এপাশ ওপাশ করে কেটেছে সারাটা রাত। ফৌজিয়া যেভাবে বাড়ি, বাড়ির মানুষ আগলে রাখত, সবদিকে যেভাবে লক্ষ্য রাখত, এভাবে আর কেউ কি পারবে?