আমরা ছেলেবেলা থেকে পড়তে পড়তে বড় হয়েছি, “লেখাপড়া করে যেই, গাড়িঘোড়া চড়ে সেই’। ছন্দমিলের এই পদ্যটি আমাদের আমার পূর্বপুরুষ পড়েছেন, তাঁর পূর্বপুরুষও পড়েছেন। এর শুরুটা ব্রিটিশ আমলে। আপাতদৃষ্টিতে এইটি নির্দোষ একটি পদ্য। শিশুদেরকে শিক্ষা গ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে কথাটি বলা হতো। সে যুগে গাড়ি ঘোড়ায় চড়াটা অনেক আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল এবং সাধারণ মানুষের কাছে গাড়িঘোড়া চড়তে পারাটা অকল্পনীয় ছিল।
কিন্তু যতটা নির্দোষ মনে হয় কথাটি ততটা নির্দোষ নয় আসলে। শিশু যখন লেখাপড়ায় অনীহা দেখাচ্ছে তখন লেখাপড়াটা কেন তার জন্যে জরুরি সেটি তাকে না বুঝিয়ে তাকে আপনি লোভাতুর করে তুলছেন। তাকে গাড়িঘোড়া চড়বার লোভ দেখাচ্ছেন। আপনি বলছেন, সে লেখাপড়া করলেই গাড়িঘোড়া চড়তে পারবে। আপনি হয়ত খবরও রাখেন না, আপনার দেওয়া এসব তথ্য শিশুর কোমল মনে গেঁথে যায়। ফলে লেখাপড়া করতে করতে সে ভাবতে থাকে, যেহেতু লেখাপড়া করেছি তাই আমাকে যে করেই হোক গাড়ি-ঘোড়া চড়লেই হবে। এবং এইটিকে সে তার অধিকারও ভাবতে থাকে। আর সেই মানসিকতা থেকে অনেকেই নিজেদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করে ফেলে। ভুলটা যখন বুঝতে পারে তখন আর সময় থাকে না।
আবার আপনিই যখন ছেলেমেয়েকে শিক্ষকের কাছে সোপর্দ করেন তখন কিন্তু বলে দিচ্ছেন, বাচ্চাটা আমার যেন মানুষের মতো মানুষ হয়! অথচ ঘরে বসেই তাকে লোভাতুর করে তুলছিলেন।
মানুষের ওপর আমিত্ব যখন ভর করে তখন তার মানবিক দিকগুলো লোপ পেতে পেতে এক সময় তুচ্ছ হয়ে যায়। একটু লক্ষ্য করে দেখুন, আজকে দেশের দুর্নীতিবাজের যে তালিকা, সে তালিকায় কিন্তু কোনো লেখাপড়া না জানা কৃষক কিংবা শ্রমিকের নাম নেই। রয়েছে বড় বড় উচ্চ পদে থাকা উচ্চ শিক্ষিত মানুষগুলোরই নাম। সরকার এদেরকে গাড়ি দেয়, বাড়ি দেয়, মোটা মাইনে দেয়- তবু এরা দুর্নীতি করে। কারণ এরা লোভী। আর গাড়িঘোড়া সম্পদ আয়েশ ইত্যাদির লোভ আপনিই এদের অভ্যন্তরে প্রোথিত করেছেন।
না, আমি বলছিনা গাড়িঘোড়া চড়াটা অন্যায় কিংবা এসব শুধু অবৈধ পন্থাতেই উপার্জিত হয়- তা নয়। তবে যখন সরকারি কর্তার পরিবার যখন একাধিক কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ায় তখন আমাদের মতো সাধারণে মনের কোণে আশ্চর্যবোধক চিহ্নটির উঁকি দেওয়াটাই খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার নয় কি?
তাছাড়া লেখাপড়ায় উচ্চমানের ডিগ্রি থাকলেই তিনি উচ্চমানসম্পন্ন মানুষ হয়ে গেলেন- সেও সত্য নয় । একজন মানুষের বৈশিষ্ট্য আর গুণাবলী আসে পারিবার থেকে, আসে যে সমাজে সে বড় হয়ে উঠেছে সে সমাজ থেকে, আসে তার চারপাশের মানুষদের কাছ থেকে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। আর হ্যাঁ। তার ধর্মীয় শিক্ষাটাও কিন্তু জীবনে অনেক ভূমিকা রাখতে পারে। একজন ভালোমানুষ গড়তে গেলে এই বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা দরকার।
ফলে গাড়িঘোড়া চড়া কিংবা সম্পদ বা আয়েশ করতে পারার লোভ দেখানোটা বন্ধ হওয়া দরকার। আমরা যেমন শিক্ষককে বলি, স্যার, একটু দেখবেন বাচ্চাটা আমার যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। এই মানুষ হতে পারাটা আসলে যে কি – সেটি শিশুকেও জানাতে হবে, শেখাতে হবে।
তাকে বড় মানুষ হতে উৎসাহ জোগাতে হবে। শেখাতে হবে প্রকৃত জ্ঞানী মানুষই বড় মানুষ। আর বইপত্র হলো সে জ্ঞানের আধার। পাশাপাশি পারিবারিক এবং ধর্মীয় অনুশাসন তাকে সুপথে চলতে সাহায্য করবে।
আমাদের দেশে যেসকল উচ্চ শিক্ষিত মানুষ অন্যদের সাথে নিয়ে গাড়িঘোড়া চড়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হতে পেরেছেন আজ তাঁরাই আমাদের ভরসা।