আমরা কতটা স্বাধীন?

0 comment 86 views

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের রাতটি ছিল বিভীষিকাময় ভয়াল একটি রাত। সে রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ কোডনেম দিয়ে সেনা অভিযানের নামে নিরস্ত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা আমাদের মানুষদের নৃশংস ভাবে হত্যা করতে শুরু করেছিল। অপারেশন সার্চলাইটের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া। ওই এক রাতেই মেরেছিল প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে।

পরদিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করে। এই আনুষ্ঠানিকতাই স্বাধীনতার ঘোষণা। তারা জানালো, আমরা আর পাকিস্তানি নই, আমরা বাঙালী। আমাদের দেশ পাকিস্তান নয়, আজ থেকে আমরা স্বাধীন। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের নাগরিক। তারপর শুরু হলো যুদ্ধ। মুক্তির যুদ্ধ। কিসের থেকে মুক্তির জন্যে যুদ্ধ করেছিল বাংলাদেশের মানুষ? কেবলই একটি ভূখণ্ডের জন্যে? না। তা নয়। কাঙ্ক্ষিত মুক্তিটা ছিল পক্ষপাতমূলক অন্যায় আচরণ, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা থেকে তো বটেই। তবে প্রধান দুটা চাওয়া ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিক মুক্তি, আরেকটি হলো অর্থনৈতিক মুক্তি। এই মুক্তি কি মিলেছে বাঙালীর? এর উত্তর খুঁজতে গবেষণা করা লাগে না। আপনি দেশের বিদ্যমান বাস্তবতার পানে চোখ বোলালেই কঠিন এই প্রশ্নটির খুব সহজ উত্তর পেয়ে যাবেন।

গরুর খাদ্যের প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে কিন্তু সেই তুলনায় দুধের দাম বাড়েনি। এছাড়া ভিটামিন-ওষুধ ও সরঞ্জামের দামও বেড়ে গেছে অনেক। যার ফলে খামারিদের পক্ষে খামার টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু দুধের দাম বেড়েছে লিটারে দুই থেকে চার টাকা। লোকসান সামাল দিতে খামারি তারিফুল ইসলামকে গত ছয় মাসে খামারের আটটি গাভি বিক্রি করতে হয়েছে।(দৈনিক প্রথম আলো, ২৫ মার্চ ২০২৩)

এখন তো পবিত্র রমজান মাস চলছে। বিকেলে পথেঘাটে চলতে রাস্তার দু পাশে নানান খাবারের পসরা দেখা যায়। কিন্তু সেসব খাবার কিনতে পারার মতো অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ক’জনের আছে? মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কাকজোর গ্রামের বিধবা সাহিদা বেগম রোজার প্রথমদিন  ইফতার করেছেন পানি দিয়ে। কাকজোর গ্রামের লোকেরা বলেছে, বাজারে পা রাখা যায় না, মাছ, মাংস, চাল ডাল আটা থেকে শুরু করে সবজি বাজারের প্রত্যেকটা জিনিসপত্রে হাত দেয়া যায় না। দিনশেষে একটু ভালো  খাবার দিয়ে ইফতার করবে সেই অবস্থা নাই। দ্রব্যমূল্যের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। চোখেমুখে একরাশ হতাশা নিয়ে তাদের উচ্চারণ, ‘জীবন বাঁচনোই কঠিন, আবার ইফতার’! (দৈনিক মানবজমিন, ২৫ মার্চ ২০২৩)।

অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি। বাণিজ্যমন্ত্রী যেহেতু বলেছেন, ভুল তো নিশ্চয়ই বলেন নি। (জাগো নিউজ২৪, ২৬ মার্চ ২০২৩)।

এক ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েরা রোজায় মাংস খেতে চেয়েছে। বাজারে গিয়ে ভদ্রলোক দেখলেন মাংসের যা দাম, ছোঁয়াও যাবে না। মুরগির গিলা-কলিজারও দামও তার সাধ্যের বাইরে। শেষে মুরগির পা কিনেছেন। বললেন, ‘এটাই আমাদের কাছে মাংস’। (রূপসী বাংলা, ২৪ মার্চ ২০২৩)

কিন্তু  কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ক’দিন আগে বলেছিলেন, মুরগির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। (রূপসী বাংলা, ১৬ মার্চ ২০২৩)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুরগির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই কৃষিমন্ত্রী সেটি স্বীকার করে নিয়েছেন। যদিও কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী ঐক্যমত পোষণ করেন না।

ওপরের খবরগুলো আমাদেরকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অর্জনগুলো জানাচ্ছে। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, যে জাতিগত নিপীড়ন এবং সবশেষে একটি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে না করাই স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়েছে কি? ২৫ নভেম্বর ২০২২ তারিখে বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশের ১% ধনীর হাতে ২৪.৬% সম্পদ। প্রতিবেদনটি আরও বলেছে, ‘২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার বেড়েছে প্রায় সাড়ে সাত গুণ। শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর সম্পদ ও আয়ের অনুপাত কিছুটা কমলেও জিডিপির বহর যে হারে বেড়েছে, তাতে এই শ্রেণির মানুষের সঙ্গে বাকিদের বাস্তব ব্যবধান অনেকটাই বেড়েছে। তবে এই ২০ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। অনেক মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে দেশে দৃষ্টিকটুভাবে বৈষম্য বেড়েছে।’

আমি আজকে স্বাধীনতা দিবসের কথা লিখতে বসেছি। এবারে আমরা ৫২তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করলাম। কিন্তু যখন শুনি, দিনমজুর জাকির হোসেন বলছে। ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ তখন বড় লজ্জায় পড়তে হয়। মানুষ যে অধিকার সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আসে সেটিকে মৌলিক অধিকার বলা হয়। মৌলিক অধিকার পাঁচটি। প্রথমটিই হলো খাদ্য। এরপর আছে বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আমরা এই ৫২ বছরে এখনও মানুষের প্রথম জন্মগত অধিকারটিই নিশ্চিত করতে পারলাম না।

পাকিস্তান আমলে উন্নয়ন থেকে আমরা ছিলাম বঞ্চিত। ফলে রাজনৈতিক স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি দুটিই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল উদ্দেশ্য। উন্নয়ন মানে তো বড় বড় ভবন, ব্রিজ, সড়ক কিংবা ফ্লাইওভার নয়। উন্নয়ন মানে হলো উন্নত মানুষ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে উন্নত চিন্তার মানুষ। এই উন্নত চিন্তার মানুষগুলোকেই একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরে পাকিস্তানিরা ঘর থেকে ধরে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছিল। আমরা কি এই ৫২ বছরে তেমন মানুষ তৈরি করতে পেরেছি আর? দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি অঙ্গনের দিকে একবার দৃষ্টি বোলালেই জবাবটা পাওয়া যাবে। তাহলে এখন যে প্রশ্নটি সামনে আসে, সেটি হলো, আমরা কতটা স্বাধীন?

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing