সৌদি আরবের একটি পরিচয় হলো- মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ। বেশ কয়েক বছর আগে ওই দেশেরই এক পত্রিকা প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, সৌদি নাগরিকরা প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করে তার অর্থমূল্য ১৩.৩ বিলিয়ন ডলার। সৌদি আরবের কৃষিমন্ত্রী তখন বলেছিলেন সৌদির প্রতিটি নাগরিক বছরে গড়ে প্রায় আড়াইশ’ কেজি খাবার অপচয় করেন। খাদ্য অপচয়ের দিক থেকে বিশ্বে এটাই সর্বোচ্চ। অবশ্য ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি খাবার অপচয় করেছে মিশর। ওই বছর মিশর ৯ মিলিয়ন টন খাবার নষ্ট করেছিল।
তবে সৌদি আরব একাই খাদ্য নষ্ট ও অপচয় করে, তা কিন্তু নয়। এই তালিকায় রয়েছে ইরাক, সুদান, আলজেরিয়া, সৌদি আরব, মরক্কো, ইয়েমেন, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, জর্ডান, আরব আমিরাত, লেবানন, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, ওমান, মৌরতানিয়া, কুয়েত, কাতার আর বাহরাইন। লক্ষ্য করুন তালিকার সবগুলো দেশই মুসলমানপ্রধান দেশ। আচ্ছা পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ যদি আরবদের মতো ধনী হতো তাহলে কি এই তালিকায় তাদের নামও থাকত?
পুরনো এক বাংলা সিনেমার কথা মনে পড়ল। ঢাকার কোনো এক বিয়ে বাড়িতে অনুষ্ঠান চলছে। শহরের সম্ভ্রান্ত মানুষজন সেখানে ভিড় করেছেন। টেবিলগুলো নানান সুস্বাদু সব খাবারে উপচে পড়ছে। বেয়ারা তারপরও পরিবেশন করেই চলেছে। অতিথিরা অতটা খেতে পারার কথা নয়। তারা সামান্য মুখে দিয়েই উঠে পড়ছেন। প্লেটের উচ্ছিষ্ট খাবার তখন বিশাল একটা ডেকচিতে ফেলা হচ্ছে। একটু পর ডেকচি ভরে গেলে কয়েকজনে মিলে সে ডেকচি তুলে রাস্তার আবর্জনা ফেলার জায়গাতে ফেলছে। সে রাস্তায় লাইন ধরে অসংখ্য মানুষ বসেছিল। উচ্ছিষ্ট খাবারের ডেকচি আবর্জনার স্তুপে উলটে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সে মানুষগুলো ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেখানে।
সিনেমাটাতে চুয়াত্তরের বাংলাদেশ দেখানো হয়েছিল। চুয়াত্তরে বাংলাদেশে একটা দুর্ভিক্ষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে সে বছর অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে বেসরকারি হিসেবে এক থেকে সাড়ে চার লক্ষ মানুষ চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে মারা যান। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কারণ আর যা-ই হোক, সেটা খাদ্য কমে যাওয়ার কারণে ঘটে নি। অমর্ত্য সেনের মতে, ‘খাদ্য থাকাটাই খাদ্য-সরবরাহের একমাত্র পূর্বশর্ত নয়, এক্ষেত্রে বহুবিধ মধ্যবর্তী শক্তির প্রভাব নির্দিষ্ট পরিবারবর্গের ক্রয়ক্ষমতাকে বিপন্ন করে।’
হ্যা,চুয়াত্তরে বাজারে পণ্য ছিল, কিন্তু সে পণ্য কেনার মতো টাকা সাধারণ মানুষের হাতে ছিল না। অতিরিক্ত লাভ করার লোভে ব্যবসায়ীরা খাদ্যপণ্য মজুদ করতে শুরু করে দিল। তখন খাবারের দাম হু হু করে বাড়তে লাগল। বাড়তে বাড়তে সে দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেল। তখনই দেখা দিল পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষ, এল মহামারি। যে লোকটা খাবারই কিনতে পারে না সে চিকিৎসা করাবে কি দিয়ে! বিনা চিকিৎসায় একের পর এক মরতে লাগল মানুষ।
সিনেমার ওই বিয়ে বাড়ির সম্ভ্রান্ত অতিথিদের মতো মানুষেরা যদি সেসময় অভাবী মানুষদের দিকে তাদের সহযোগিতার হাতটি বাড়িয়ে দিত তাহলে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ হয়ত হতোই না। মৃত্যু হতো না অতগুলো মানুষের। ৪৯ বছর পর বাংলাদেশে এখন খাদ্য থেকে নিত্য পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক বছরে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কমেছে। অর্ধ শতক সময় পেরিয়ে গেলেও, আগের প্রজন্ম পেরিয়ে একটা নতুন প্রজন্ম ব্যবসার হাল ধরলেও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের চরিত্র এখনও পাল্টায় নি।
কিন্তু বাস্তবতা হলো সারা পৃথিবীতে খাবার নষ্ট করার তালিকায় আরব দেশগুলোই শীর্ষে। জাতিসংঘ বলেছে আরবিদের নষ্ট করা খাবার দিয়ে ১০০ কোটি মানুষকে খাওয়ানো যাবে।
ক’দিন আগে খবরের কাগজ লিখল জাতিসংঘ বলেছে, বিশ্ব জুড়ে এখন সাড়ে তেয়াত্তর কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে। ভাবুন তো, সাড়ে তেয়াত্তর কোটি মানুষ এই মুহূর্তে না খেয়ে আছে! এই সংকট এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গবেষকরা বলছেন, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার যে প্রভাব তাতে খাদ্যঘাটতির এই অস্থিতিশীলতা আরও বাড়তে পারে। পরিবেশে আমরা যে সংকট তৈরি করেছি, পরিবেশও পাল্টা আঘাত করতে শুরু করেছে। এই আঘাতেরই ফল খাদ্যসংকট। এরপরে ঘটবে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি। মানুষ যখন নিজের আশ্রয় হারাবে তখন শুরু হবে সংঘাত। গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই চাপ বহন করার সামর্থ্য আমাদের নিজেদের তো নেই-ই আমাদের এই পৃথিবীটিরও নেই।
কিন্তু মানুষের দারিদ্রতায় আমাদের কিছু যায় আসে না। মানুষের না খেয়ে থাকার খবরটিতে আমরা চোখ বুলিয়ে নিদারুণ উদাসীনতায় খবরের কাগজের পাতা ওলটাই। আমাদের বিধ্বংসী কাজকর্মের কারণে পুরো পৃথিবী এখন পুড়ছে। কিন্তু আমরা ব্যস্ত রয়েছি যুদ্ধ নিয়ে। ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধ চলছে, সে যুদ্ধ আমরা থামাতে চেষ্টা না করে আরও উসকে দিচ্ছি। আরও কিছু দেশ মারমুখি হয়ে আছে। যে কোনো সময় তাদের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
চাপ বহনের ক্ষমতা আমাদের আছে আছে কি নেই- সেটি প্রধান বিষয় নয়। প্রধান বিষয় হলো আমরা মানবিক কিনা। মানুষ যদি মানবিক হয় তাহলে সৃষ্ট সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারত। মানবিক সহযোগিতা নিয়ে আর্ত মানুষদের পাশে। কেবল প্রকৃতি চাপে আছে- তা নয়, আসলে গোটা মানবতাই চাপে রয়েছে এখন। সাড়ে তেয়াত্তর কোটি অভুক্ত মানুষের খাবারের সংকট নেই আসলে। এই সংকট কৃত্রিম সংকট। পৃথিবীর জনসংখ্যা আটশ’ মিলিয়নেরও বেশি। এত এত মানুষের যদি খাদ্যের অভাব না হয় তাহলে ওই সাড়ে তেয়াত্তর কোটি মানুষের খাবারের অভাব কেন হবে? অভাব নেই আসলে। মূল অভাবটা হলো মানবিকার। মানবিকতার অভাব আছে বলেই অস্ত্র তৈরি হয়, যুদ্ধ বাধে। মানবিকতার অভাব ছিল বলেই দেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলছিল তখনও কিছু লোক বিশাল আনুষ্ঠানিকতায় বিয়ের আয়োজন করেছে। আর মানবতা রাস্তায় আবর্জনার পাশে বসে বুভুক্ষু হয়ে সে আনুষ্ঠানিকতা দেখেছে। চেয়ে চেয়ে অপেক্ষা করেছে একটু উচ্ছিষ্টের আশায়।
আমরা যে মানবিক সেটি প্রমাণ করার এখনই সময়। আসুন আমরা মানবিক হই।