আশির দশকে বিটিভিতে দেখা একটা নাটকের কথা মনে পড়ে গেল। মধ্যবিত্ত নুরু তার স্ত্রী রাবেয়াকে ঢাকা শহরে এসেছেন। তার ইচ্ছা একটা ব্যবসা ট্যবসা শুরু করে ঢাকাতেই থেকে যাবেন। কিন্তু নুরুর হাতে খুব বেশি টাকাপয়সা নেই। স্ত্রীকে নিয়ে উঠেছে ছেলেবেলার সাবেরর দু কামরার বাসায়। সাবেরও মধ্যবিত্ত। তবে তার নানান লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে। সাবের একদিন সস্ত্রীক নুরুকে নিয়ে গেল এক ধনী ব্যবসায়ী সিডনীর কাছে। সিডনী তার বাসায় নুরু আর রাবেয়াকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানালো।
পরদিন সে নুরু রাবেয়াকে নিয়ে গেল ডিনারের নিমন্ত্রণে। বিশাল আলিশান বাড়ি, চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জা। নুরু মুগ্ধ। ডিনার হলো, মদ্য পানও চলল। এক পর্যায়ে ধনী ব্যবসায়ী বলল, আপনি তো ব্যবসা করতে চান। আসুন। আপনার ভাগ্যটা যাচাই হয়ে যাক। তারপর তাস বের করল। নুরু জীবনেও তাস খেলে নি। কিভাবে খেলতে হয় তাও জানে না।
সিডনী বললেন, আরে এটা কোনো সমস্যা হলো? আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।
নুরু কিছুতেই না করে না। সিডনী তাকে তিন তাস খেলা শিখিয়ে ফেলল। তারপর চলতে লাগল খেলা। একটু পর সিডনী বললেন, বাজি না হলে খেলায় মজা হয়? আসুন বাজিতে খেলি।
নুরু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তার কাছে ব্যবসার টাকা। সে টাকা খোয়ালে পথে বসতে হবে। সিডনী নুরুর ভাবনা বুঝে ফেললেন। বললেন, আরে এত ভাবছেন কেন! এটা তো খেলাই। সিরিয়াস কিছু না। তাছাড়া এমনও হতে পারে আপনি জিতে গেলেন। তাহলে ব্যবসার মূলধন বাড়বে।
অগত্যা নুরু রাজি হলো। বাজিতে খেলা চলতে লাগল। নুরু জিততে লাগল। অনেক অনেক টাকা জিতে ফেলল নুরু। সে তখন দারুণ উত্তেজিত। সে উত্তেজনা দেখে রাবেয়ার আশংকা হলো, সে বলল, আর খেলো না, চলো আমরা যাই।
সিডনীর মুখে তখন চাপা হাসি। একটু পরই নুরু হারতে শুরু করল। একটু পর দেখা যা জিতেছিল তার সবই সিডনীর কাছে ফেরত গেছে। নুরুর জেদ চাপলো। ব্যবসার মূলধনও হারতে হারতে সবটাই হারলো। আরেকটু পরই নুরু নিঃস্ব। হতাশায় নুরু নেতিয়ে পড়ল। আবার খেলে যে ব্যবসার টাকাটা তুলতে চেষ্টা করবে সেটাও সম্ভব নয়। সিডনীর কাছে ধার চাইল। সিডনী বললেন, টাকা আপনাকে আমি দিতেই পারি কিন্তু জুয়ার টেবিলে ধার দেওয়ার নিয়ম নেই।
হতাশা নুরুকে গ্রাস করল। সিডনী তখন বললেন আপনি চাইলে এখনও খেলতে পারেন।
ডুবে যাওয়া মানুষ যেভাবে ভেসে ওঠে নুরুও সেভাবে উঠে বসে বলল, কিভাবে?
সিডনী নুরুর স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, উনাকে বাজি ধরতে পারেন। যদি জিতে যান তাহলে আপনার হেরে যাওয়া সব টাকার দ্বিগুণ ফেরত পাবেন। আর যদি হেরে যান তাহলে উনাকে আমার এখানে রেখে যাবেন।
নুরু ও রাবেয়া স্তম্ভিত। এ হতেই পারে না। রাবেয়া বলল, চলো, আমরা এক্ষুনি এ বাড়ি থেকে চলে যাব। নুরু কিছু বলে না। চুপ করে বসে থাকে। রাবেয়া আবার তাড়া দেয়। নুরু তখন বলে, রাবেয়া শোন, তুমি রাজি হয়ে যাও, দেখে নিও এবারে আমি জিতব। মাত্র একবার। প্লিজ রাজি হও।
রাবেয়া পাথর হয়ে যায়।
খেলা শেষে সিডনী নুরুকে বলে, আপনি রাবেয়াকে নিয়ে চলে যান। কিন্তু রাবেয়া আর যায় না নুরুর সঙ্গে। সিডনীর সঙ্গে সিডনীর বাড়িতেই থেকে যায়।
.
গ্যাম্বলিং বা বেটিংকে আমরা বাংলায় বলি বাজি ধরা কিংবা জুয়া। যখন থেকে জুয়া এসেছে তখন থেকেই মানুষের সর্বনাশ করে চলেছে। অভিধানে জুয়া বা বাজি শব্দটির অর্থ হলো যে খেলায় বাজি রাখা হয়। জুয়া শব্দটির সমার্থক শব্দ হলো চুরি, জোচ্চুরি, ধোঁকাবাজি, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, শঠতা, ঠকামি ইত্যাদি। ওপরের গল্পের নুরু যার সব কয়টিরই শিকার। জুয়াকে কোনো এক অদ্ভুত কারণে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা খেলা বলে অভিহিত করেন। সেক্ষেত্রে কেন জুয়াকে খেলা বলে অভিহিত করেন সেটি জানি না। জুয়া খেলায় নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকাপয়সা নির্ধারণ করা হয়। তারপর দু পক্ষ একটি চুক্তিতে আসে। যে পক্ষ জিতবে টাকাপয়সাগুলো সে নিয়ে নেবে।
জুয়ায় অন্যতম জনপ্রিয় খেলাটির নাম ক্যাসিনো। ক্যাসিনো শব্দটি ইতালীয় ভাষার। ক্যাসা হলো ঘর। ছোট ভিলা, গ্রীষ্মকালীন ঘর কিংবা সামাজিক ক্লাবকে ক্যাসিনো বলা হতো। উনিশ শতকের দিকে যেসব ভবনে আনন্দদায়ক কাজকর্ম হতো, যেমন নগরের সামাজিক অনুষ্ঠান যেখানে নাচ, গান, জুয়া ও ক্রীড়ার ব্যবস্থা থাকত সেগুলোকে ক্যাসিনো বলা হতো। কিন্তু এখন জুয়ার আড্ডাকে ক্যাসিনো বলা হয়। তবে এসব জুয়ার আড্ডা তৈরি হয় বিশাল পরিসরে। থাকে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, আনন্দ ভ্রমণ জাহাজ এবং অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ থাকে। কিছু কিছু ক্যাসিনোয় সরাসরি বিনোদন প্রদান যেমন স্ট্যান্ড আপ কমেডি, কনসার্ট, খেলাধুলা ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। অনেক জায়গায় থাকে গণিকাবৃত্তিও। বলাবাহুল্য এসব আয়োজন আসলে ধোঁকাবাজি, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, শঠতা, ঠকামির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। আর প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এই জুয়া সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল মাধ্যমে নতুন রূপ পেয়েছে।
নুরুর গল্পটি গল্প হলেও আসলে গল্প নয়। এ গল্প আমাদের চারপাশ থেকেই উঠে আসা কারও না কারও বাস্তবতা। এই বাস্তবতা কখনও থেমে নেই। সবসময়ই প্রবহমান। আমরা দেখেছি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বেয়ে এই অকাল ধ্বংস ক্রমাগত মানুষকে গ্রাস করেই চলছে। ভেঙে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পড়ছে হুমকির মুখে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বাড়ছে মানবতা বিধ্বংসী অসংখ্য অপরাধ। বাড়ছে মাদকাসক্তি। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সন্ত্রাস। জোচ্চুরি, ধোঁকাবাজি, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, শঠতা, ঠকামির মতো জুয়ার সমার্থক শব্দগুলো জ্বলজ্বলে হয়ে জ্বলছে আমাদের চারপাশে, পুরো পৃথিবী জুড়েই।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৬-২২ সাল পর্যন্ত গোটা বিশ্ব জুড়ে মানুষ যে পরিমাণ অর্থ জুয়া খেলায় হারিয়েছেন, তার পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এবং জুয়া খেলার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি এশিয়াতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকা।
জুয়া থেকে রক্ষা পেতে মনোবিজ্ঞানীরা সাইকোথেরাপিও মনরোগের ওষুধসহ নানান ব্যবস্থার কথা বলেন। কিন্তু আমার মনে হয় এই সমস্যাটির মূল সমাধান দিতে পারে শিক্ষা ব্যবস্থা। সেই যে আমাদের পিতারা শিক্ষকের কাছে সন্তানকে দিয়ে বলতেন, স্যার ছেলেটা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। আর কোনো চাওয়া থাকত না। আজকের পিতামাতাদের সন্তানকে নিয়ে অনেক চাওয়া। শুধু মানুষের মতো মানুষ বানাবার চাওয়াটা নেই।