আমাদের ছেলেবেলায় পাড়ায় চারজন অন্ধ ভিক্ষুক আসত। এরা লাইন ধরে একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে ধরে রেখে গান গাইতে গাইতে হাঁটত। প্রত্যকের চোখেই কালো কাচের চশমা। গান গাওয়ার ক্ষেত্রে এদের একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল। যিনি সামনে থাকতেন তিনি প্রথমে একটি লাইন গাইতেন। তারপর বাকি সকলে পরের লাইনটি একসঙ্গে গাইত। আমাদের ধারণা হয়েছিল, যিনি সামনে হাঁটতেন তিনি বুঝি নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তার গানের কণ্ঠটি সবচেয়ে ভালো। কিন্তু আমাদের এ ধারণাটি খুব ভুল ছিল। কেননা পরের সপ্তাহেই দেখা যেত পেছন সারির কেউ একজন সামনে চলে এসেছেন এবং গানের নেতৃত্বটি তিনিই দিচ্ছেন। এভাবে কিছুদিন পরপর ভিক্ষুকদের সে সারির সামনের লোকটি বদলে যেত। এবং তারা যখন পাড়ায় ঢুকত সকলের মনোযোগ তাদের দিকেই চলে যেত। তবে দুঃখজনক হলো তাদের ভিক্ষা সংগ্রহের পাত্রটি আশানুরূপ সহযোগিতার স্পর্শ পেত না।
আমাদের এক বয়োজ্যেষ্ঠ একদিন এই চারজনকে দেখিয়ে খুব আক্ষেপ করে এদের জীবন প্রণালির কথা বলছিলেন। তাঁর কথা সারমর্ম হলো, এরা কিছুই দেখতে পায় না, ফলে লেখাপড়াও করতে পারে না। নিজের চারপাশের শব্দই ওদের পৃথিবী। সে বয়সে ওই উপলব্ধিটি খুব ছুঁয়ে গিয়েছিল আমায়, তাইত! এরা তো কোনো কিছুর রূপ-অরূপ-স্বরূপ দেখতেই পেল না! বই পড়লেও তো অনেক কিছু জানা হয়ে যায়। এরা এমনই দুর্ভাগা যে বইয়ে ছাপা লেখাগুলোই তো দেখতে পায় না! সেদিন বুকে বড় বেজেছিল আমার।
কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠের উপলব্ধি আর আক্ষেপ সত্য হলেও সবটা যে সত্য নয় সেটি আমি জেনেছিলাম অনেক পরে। জেনেছি অন্ধদের লেখাপড়া করবার একটি ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়েছে আসলে। এই আবিষ্কারটি করেছিলেন লুইস ব্রেইল। ব্যবস্থাটির নামও তাই তাঁর নামে- ব্রেইল পদ্ধতি।
লুইস ব্রেইল ফ্রান্সের মানুষ। জন্ম ১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারি, প্যারিস শহরে। লুইস ব্রেইল নিজেও অন্ধ মানুষ ছিলেন। না, জন্মান্ধ ছিলেন না তিনি। তিন বছর বয়সে বাবার কারখানায় খেলতে গিয়ে সুঁই জাতীয় ধারালো কিছু দিয়ে চামড়ায় গর্ত করার সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটল। মারাত্মক সে দুর্ঘটনায় লুইসের দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেল। আর ভালো হলো না। অন্ধ হয়ে গেলেন লুইস ব্রেইল। কিন্তু দৃষ্টি হারালেও দৃষ্টিহীন জীবনকে মেনে নিতে পারলেন না ব্রেইল। দৃষ্টি ছাড়াই জীবনকে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর হলেন তিনি।
লুইস কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করতে লাগলেন অন্ধ হওয়া মানেই পরিবার বা সমাজের বোঝা নয়। অন্ধরাও স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে পারেন। এমনকি পড়ালেখা শিখে নিজ পায়েও দাঁড়াতে পারেন।
এরপর যখন দৃষ্টিহীনদের জন্যে লেখ্য ভাষা আবিষ্কার করলেন, তখন লুইস ব্রেইল মাত্র পনের বছর বয়সের কিশোর এক। সে বয়সেই তিনি অন্ধদের লেখা ও পড়ার জন্য কাগজের ওপর মাত্র ছয়টি ডট দিয়ে একটি অতি সহজ এক ভাষা ও পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। আবিষ্কারের পাঁচ বছর পর ১৮২৯ সালে ব্রেইল পদ্ধতি জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়। এ বর্ণমালায় বিভিন্ন জ্যামিতিক প্রতীক এবং বাদ্যযন্ত্রের চিহ্ন অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই পদ্ধতির নামটিও লুইস ব্রেইলের নিজেরই নামে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠা পেল- ব্রেইল পদ্ধতি। অন্ধ লোকেদের জীবন সেই ছয়টি ডটের জাদু আমূল বদলে দিল। ব্রেইল খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বিজ্ঞান আর সঙ্গীতের দিকে ছিল তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ। পরবর্তীতে চার্চে অর্গান বাজাতেও শুরু করেন। পাশাপাশি তরুণদের অন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও শিক্ষক হয়ে ওঠেন।
ব্রেইল চেয়েছেন, তাঁর মতো দৃষ্টিহীন মানুষেরা যেন সমাজের বোঝা হয়ে না থাকেন। তারাও যেন সমাজের অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারেন। এ জন্যই লুই অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কার করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটান।
আজ এক থেকে ছয়টি বিন্দু স্পর্শ করে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ লেখাপড়া শিখছেন। এ পদ্ধতি এখন বিশ্বের সর্বত্র পরিচিতি পেয়েছে এবং প্রচলিত সকল ভাষায় গ্রহণ করা হয়েছে।
লুইস ব্রেইলের জন্মের দিনটিকে স্মরণ করে রাখতেই তাঁর জন্ম নেয়ার দিনটিকে বিশ্ব ব্রেইল দিবস ঘোষণা করা হলো।