ভূমিকা:
ভারত একটি বহুত্ববাদী সমাজ হিসেবে পরিচিত। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতির বিপুল বৈচিত্র্য নিয়ে গড়ে উঠেছে এর গণতান্ত্রিক কাঠামো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে একটি নতুন ধরনের রাজনৈতিক রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—যেখানে সন্দেহ একটি সাংগঠনিক কৌশলে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, মুসলমান পরিচয়কে ঘিরে যেভাবে এক ধরণের ভীতি, অবিশ্বাস ও বিভেদমূলক বয়ান তৈরি করা হচ্ছে, তা শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়—ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনার জন্যও গভীর হুমকি।
১. নাগরিকত্ব ও সন্দেহের কাঠামো
২০১৯ সালে পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA), এবং আসামের NRC প্রক্রিয়া, ভারতীয় মুসলমানদের কাছে এক গভীর আশঙ্কার নাম হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষ, যাদের অনেকেই যুগ যুগ ধরে ভারতে বসবাস করছেন, আজ ‘অবৈধ’ নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত। নাগরিকত্বের প্রশ্নকে ধর্মভিত্তিক করে তোলার এই প্রয়াস ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
২. ইতিহাসের পাতায় মুছে ফেলার চক্রান্ত
NCERT এর পাঠ্যক্রমে মুসলমান শাসকদের ইতিহাস বাদ দেওয়া, মুঘল স্থাপত্যের অবদান অস্বীকার করা, শহরের নাম পরিবর্তন—এসবই মুসলমান পরিচয়ের সাংস্কৃতিক উপস্থিতিকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য করে দেওয়ার চেষ্টা। এই প্রবণতা শুধু অতীতের বিকৃতি নয়, বরং বর্তমানকে প্রভাবিত করার রাষ্ট্রীয় প্রকল্প।
৩. ভয়ের সংস্কৃতি ও দমনমূলক রাষ্ট্রনীতি
CAA বিরোধী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে অনেক মুসলমান কর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে UAPA-এর মতো কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। সাফুরা জারগারের গ্রেপ্তার, দিল্লি দাঙ্গার সময়ে পক্ষপাতমূলক পুলিশি আচরণ, এমনকি সংবাদমাধ্যমে মুসলমানদের ‘দেশদ্রোহী’ চিত্রায়ন—সবই একটি দমনমূলক রাষ্ট্রনীতির ইঙ্গিত দেয়।
৪. নীরব সমাজ, আওয়াজহীন প্রতিবাদ
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি হলো সমাজের নীরবতা। ভারতের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আজ অনেকাংশেই এ বিভাজনকে প্রশ্রয় দিচ্ছে—হয় মৌন সম্মতিতে, নয়তো ভয়ের কারণে। গণতন্ত্রের জন্য যা সবচেয়ে বিপজ্জনক তা হলো—ভুলকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া।
উপসংহার:
ভারত তার ইতিহাসে বহু ঝড়-ঝাপটা সামলে আজ এখানে এসেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের শক্তি শুধু নির্বাচন নয়, বরং ন্যায়বিচার, সংহতি ও নাগরিক মর্যাদায়। আজ সেই ভিত্তিই প্রশ্নের মুখে।
মুসলমানদের নিয়ে যে সন্দেহের রাজনীতি চালানো হচ্ছে, তা আদতে গোটা দেশের জন্য এক অন্ধকার ভবিষ্যতের সংকেত। সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের, গণমাধ্যমের ও নাগরিক সমাজের—প্রতিবাদ করতে, প্রশ্ন করতে এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে।
কারণ গণতন্ত্রের শেষ কণ্ঠস্বর যদি স্তব্ধ হয়ে যায়, তাহলে আর কোনো সম্প্রদায়ই নিরাপদ থাকে না।