ইসমাইল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে থাকে। থাকছে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে। ইসমাইল যখন কাতারে যায় তখন সে একেবারেই ছেলেমানুষ, পনেরো-ষোল বছরের কিশোর। নিজের বয়সের তিনভাগের একভাগ জীবন সে কাটিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ওই গরম দেশটির মধ্যেই। প্রবাস জীবনে প্রথমবার দেশে গিয়েছিল দশ বছর পর। সেবার দেশে গিয়ে পাত্রী দেখে-টেখে বিয়ে করে ফেলল ইসমাইল। বিয়ের তিন মাস পর আবার কাতার চলে আসতে হলো। ছুটি শেষ। এক বছর পরে আবার মিলল ছুটি। এবারে এক মাসের ছুটি। মালিকপক্ষকে অনেক অনুরোধ করার পর সাতদিন বাড়ল ছুটি। তারপর দেশে এসে ফ্লাইটের আগে আগে আবারও সাতদিন বাড়ানো গেল। ওই দেড় মাসই। ইসমাইল বছরে দেড় মাস পরিবারের সঙ্গে কাটাবার বৈধতা পেল।
এভাবেই ইসমাইল একদিন মেয়ের বাবা হয়ে গেল। ওর মেয়েটা যখন সিক্সে পড়ে তখন ইসমাইলের একটি ছেলেও হলো। তারপর সে ছেলে স্কুলে ভর্তি হলো। একের পর এক ক্লাস পাল্টাতে লাগল। বছর পাঁচেক আগে ইসমাইল ভাবল, অনেক তো হলো বিদেশ থাকা, এবার দেশে ফেরা দরকার। বাচ্চা দুটা টুকটুক করে বেড়ে উঠছে, বাপ হয়ে ইসমাইল সে বেড়ে ওঠা দেখবে না!
তারপর একদিন মধ্যপ্রাচ্যের পাট চুকিয়ে ইসমাইল সত্যি সত্যিই দেশের পথে পাড়ি জমালো। দেশে এসে ইসমাইল বিশ লাখ টাকা দিয়ে চারটা সিএনজি অটোরিকশা কিনে ফেলল। ওর হিসেবটা হলো, একটা সিএনজি অটোরিকশা থেকে রোজ পাওয়া যাবে পাচশ’ টাকা। তাহলে চারটা থেকে আসবে দু হাজার টাকা। মাসে হবে ষাট হাজার। ওর সংসার চালিয়ে বেশ কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। এভাবে শুরুটা ভালোই ছিল। কিন্তু মাস কয়েক যেতেই সমস্যা দেখা দিল। রাস্তায় ট্রাফিক-সার্জেন্ট যখন তখন আটকে দেয়। টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে মামলা করে দেয়। ইসমাইল এসব প্যাঁচ বুঝতে পারে না। তখন দালাল আসে। দালাল পুলিশের সঙ্গে মধ্যস্থতা করে দেয়। ফলাফল, পুলিশকে টাকা দিলেই যেখানে ঝামেলা মুক্ত হওয়া যেত, সেখানে এখন দালালকেও টাকা দিতে হচ্ছে।
এছাড়া পথে ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয়, তখন রিপেয়ারিং আর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ। চার সিএনজি অটোরিকশার জন্যে বাসায় গ্যারেজ বানানো হয়েছে, তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাছাড়া ড্রাইভাররাও জমার টাকা ফাঁকি দিতে লাগল, নানান ঝক্কি। একসময় ইসমাইল ধৈর্যহারা নে সহজে আসে না। বাবা তার কাছে একজন অচেনা মানুষ।
ইসমাইলের গল্পটা মনে পড়ল ‘গ্লোবাল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ইনডেক্স ২০২২’ প্রতিবেদন দেখে। প্রতিবেদনে ১০০টি দেশ ও ১ হাজার শহরকে বিবেচনায় নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন বলছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় পিছিয়ে থাকা দেশেগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। স্টার্টআপ নিয়ে তৈরি করা বিশ্বের এক হাজার শহরের তালিকায় বাংলাদেশ থেকে স্থান পেয়েছে শুধু ঢাকা। বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোতে ভালো বিনিয়োগ আসছে। এটিকে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘স্টার্টআপ ব্লিঙ্ক’- এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম। মজার ব্যাপার হলো, কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেলেও স্টার্টআপে নিজেদের গতি ধরে রেখেছে শ্রীলঙ্কা। আগের বছরের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়ে ১০০ দেশের মধ্যে ৯০ তম স্থানে এসেছে দেশটি। প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মানুষকে উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঠেলে দেয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে স্টার্টআপ ব্লিঙ্ক। অন্যদিকে এ বছর ১ হাজার শহরের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে খুলনা ও চট্টগ্রাম।
স্টার্টআপ ব্লিঙ্ক বলেছে, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় সমর্থন দরকার। ইন্টারনেট সেবায় স্থিতিশীলতাসহ অবকাঠামোগত উন্নতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারের নীতিগত সহায়তা, করপোরেট ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও স্টার্টআপবান্ধব শিল্প-অ্যাকাডেমিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
ইসমাইল ছেলেটির এই সহযোগিতারই বড় অভাব ছিল। পঁচিশ বছর পর দেশে ফিরে সে চারজন মানুষের কর্মসংস্থান করেছিল। সহযোগিতা পেলে চার থেকে সংখ্যাটি বৃদ্ধি পেত। সহযোগিতা পেল না বলে তাকে আবারও স্ত্রী সন্তান পরিবার রেখে প্রবাস জীবনেই ফিরে যেতে হলো।
প্রতিবেদনের আরেকটি তথ্য বলে শেষ করি, বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় স্টার্টআপে চার গুণ বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে, যার বেশির ভাগই এসেছে দেশের বাইরে থেকে। স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের জন্য এটা বড় সুযোগ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।