আমাদের দর্পণ কবীর বলল, তেলবাজদের লক্ষ্য হলো ধনী মানুষদের পকেট। আর ধনী মানুষদের লক্ষ্য হলো মাইক্রোফোন ও মঞ্চ। এদের মধ্যে একটা অংশ আছে ধুরন্ধর। এই ধুরন্ধররা আরেক ধাপ এগিয়ে টাকাপয়সার বিনিময়ে পদক দেয়, সনদ দেয়। এইসব লেনদেনের আড়ালেই সুবিধাবাদীরা সব কূল সামলে আপনাপন স্বার্থ চরিতার্থে ব্যস্ত।
দর্পণের এসব কথাবার্তা শুনে আমার কাজী নজরুলকে মনে পড়ে- সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”/ মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে!/ হুজুরের মতে অমত কার?”
বেচারা সাহেব মোসাহেবের মোসাহেবীর যন্ত্রণায় শেষ পর্যন্ত “চমতকার”টি আসলে যে কি তা বলতেই পারেন না!
মোসাহেব হলো তোষামুদে চাটুকার। এরা নির্লজ্জ ও ভীষণ রকম অযোগ্য। আসলে এই নির্লজ্জতা ও অযোগ্যতাই মোসাহেবদের যোগ্যতা। এটি তারা আপনার আমার চেয়েও ভালো জানেন। এবং জানেন বলেই তারা তেলবাজি করে করে আমাদের সামনে তুমুল তেলতেলে হাসিটি হাসতে পারেন। আমরা তাদেরকে এড়িয়ে চললেও গায়ে পড়ে এসে খাতির জমানোর চেষ্টা করেন।
এই চেষ্টাটাই তার পুঁজি। কোনো একদিন এই খাতির আলাপের ফাঁকে প্রস্তাব দিয়ে ফেলবে, ভাই, আমরা সমাজের বিদগ্ধ জনদের একটা অ্যাওয়ার্ড দেব ঠিক করেছি। আমি আপনার নাম প্রস্তাব করেছি। সব ব্যবস্থা আমি করব, আপনি শুধু কিছু ডোনেশনের ব্যবস্থা করে দেবেন।
এটা আসলে ফাঁদ। ধনীদের জন্যে বড় লোভনীয় ফাঁদ। মানুষ যখন দরিদ্র থাকে তখন তার ভাবনাটি ব্যস্ত থাকে আয় রোজগার নিয়ে। সে দারিদ্রতা কাটিয়ে পয়সাকড়ির মালিক হয়ে গেলে তার ভাবনাটি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। সে তো এখন সমাজের হোমডরা-চোমরাদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেছে- এটা মানুষ জানবে না? মানুষদেরকে জানাতে হবে না?
তখনই ‘কতিপয় কপট-বাটপার মহাজ্ঞনী ভাব ধরে’ মানুষদেরকে জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসে। এদের চলনে বলনে ফুটে ওঠে এদের সংস্কৃতি আর শিক্ষা। অথচ তবুও এরা সর্বত্র বিরাজমান। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ থেকে কয়ক লাখ মানুষ এসে বসবাস করছেন। মজার ব্যাপার হলো বাংলাদেশ থেকে ওই দেশপ্রেমিক মানুষদের সঙ্গে ‘কতিপয় কপট-বাটপার মহাজ্ঞনী ভাব ধরে’ থাকারাও চলে এসেছেন। এদের লক্ষ্য নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশের সহজ সরল আর একটু স্বচ্ছল মানুষজন। সেকারণেই এরা প্রগতিশীলদের সভা বা আড্ডার অংশ হয়ে যায়।
আমাদের দর্পণ কবীর নিউ ইয়র্কের এসব মানুষদের দেখে দেখে চুপ হয়ে যান, বাকরুদ্ধ হয়ে যান। হতাশ হয়ে ঝড়কে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন সব অচলায়তন ভেঙে দিতে। শুনে আমি মিটিমিটি হাসি।
অন্ধকার আছে বলেই তো আমরা আলোর প্রয়োজনীয়তা ও শক্তিটাকে বুঝতে পারি। তেমনি কপট-বাটপার মহাজ্ঞানী ভাব ধরে থাকা এসব কতিপয় মানুষ আছে বলেই আমরা জানতে পারি স্বচ্ছ মানুষ আমাদের কতটা প্রয়োজন। এদের দেখেই আমরা নিজেরা সাবধান হবো। এদের উপস্থিতি আছে বলেই আমরা আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে উৎসাহিত হবো যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মটি এদের ছায়াও না মাড়ায়।
ঠিক এই উপলব্ধি থেকেই তো দর্পণও বলল, প্রতিটি মানুষের চেতনায় প্রবলভাবে সক্রিয় থাকুক নৈতিকতাবোধ, সততা, সত্য ও সুন্দর।