আপনি কি সুখি?
খুব সহজ একটি প্রশ্ন। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরটি সহজ নয় মোটেই। একটা কথা প্রচলিত আছে, বোকা মানুষ নাকি সুখি হয়।
এক বন্ধুর কাছে বোকাদের সুখি হওয়ার কারণ কি জানতে চাইলে বসে বলল, বোকা মানুষের অভিযোগ কম থাকে, এরা বারবার ভুল করে বকা খেয়েও লজ্জিত হয় না। বোকারা বোকা বলে তাদেরকে বড় কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয় না। সবাই এদের পাশে থাকে, সহানুভূতি দেয়, সুবিধাও দেয়, কেননা এরা বাধ্যগত। ফলে এদের ওপর দোষ চাপানো যায়। দোষ চাপালে এরা একটু মনখারাপ করে বটে, তবে সেটা মনে রাখে না। অর্থনৈতিক বিষয়েও একই ব্যাপার। একই পদে বছরের পর বছর থেকেও এরা আর্থিক সুবিধা বাড়াবার কথা বলতে মুখ খোলে না।
বন্ধুর এসব কথা বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। তবে এটুকু বোঝা গেল যে, বোকা মানুষকে তার আশপাশের মানুষেরা খুব পছন্দ করেন কেননা তার কোনো অভিযোগ নেই। আর যাকে সবাই পছন্দ করেন সে তো সুখি হবেই।
কিন্তু তাই বলে বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সুখি হতে পারবে না এটা কেমন কথা!
আমরা সকলেই তো বীরবলকে জানি। সম্রাট আকবরের রাজসভার মন্ত্রী বীরবল তার বুদ্ধিমত্তার জন্যে কিংবদন্তী হয়ে আছেন।
একবার দরবারে বিশেষ অধিবেশন চলছে। রাজসভায় সকলেই উপস্থিত। সম্রাট আকবর বীরবলের কাছে জানতে চাইলেন, আচ্ছা বীরবল, বলো দেখ জগতে প্রকৃত সুখি মানুষ কে? যদি ঠিক ঠিক বলতে পারো তবেই বুঝব আসলেই তুমি বুদ্ধিমান।
বীরবল একটু ভেবে বললেন, জাঁহাপনা, এ জগতে কোনো মানুষই সুখি নয়। মানুষ সুখি হয় শুধু মৃত্যুর পরে, তার আগে নয়।
সম্রাট আকবর একথা শুনে বীরবলের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করলেন, কেন? এমন কেন হবে? ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দাও।
বীরবল বললেন, জাঁহাপনা, আজ যে নিজেকে সুখি ভাবছে হয়ত কালই সে এমন তুলনাহীন দুঃখে পড়তে পারে। নিজেকে আজ যে সুখি ভাবছে, তাকে দেখুন সে আগামীকালের চিন্তায় সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। কালকের চিন্তা-ভাবনা তার সব সুখ স্বপ্নকে মুহূর্তে ওলটপালট করে দিচ্ছে। সবাই যাকে সুখি ভাবছে সে সত্যিকারের কী সুখ পেল কিনা সেটা সেও কি জানে? তাই বলছি প্রকৃত সুখ আসে মৃত্যুর পরেই। কেননা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের সব দুঃখের অবসান ঘটে। সেজন্য মৃত্যুর পরেই সবাই সুখী হয়।
জীবনানন্দ বলছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। আমার এক বন্ধু জীবনানন্দ থেকে ধার করে বলত, সকলেই সুখি নয়, কেউ কেউ সুখি। কিন্তু বীরবল তো এই ‘কেউ কেউ’দের মেরেই ফেললেন!
সুখ একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। আপেক্ষিক মানে তো নির্ভরশীল। তার মানে সুখ আসলে ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ যেমন আলাদা তেমনি তাদের সুখানুভূতিও আলাদা রকমের। ওই যে বীরবল বলল, ‘সবাই যাকে সুখি ভাবছে সে সত্যিকারের কী সুখ পেল কিনা সেটা সেও কি জানে?’
জীবিত মানুষ সুখি কি সুখি নয় নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে হয়ত, কিন্তু বীরবলের এই কথাটি ঠিক।
সুখ তো মানবিক অনুভূতি। সুখ মানব মনের এমন একটি অবস্থা বা অনুভূতি যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সেকারণেই মানুষ সুখ প্রত্যাশী। কিন্তু সবাই যেমন সুখি হয় না, তেমনি সুখী হওয়াটা একেক জনের কাছে একেক রকম। দেখা যায়, একজন যাতে সুখি, অন্যজন তাতে অসুখি। সুখের ব্যাপারটি একই সঙ্গে মানসিক ও পারিপার্শ্বিক। সুখ রহস্যাবৃত। কখনও বোঝা যায়, কখনও যায় না। সুখ কখনও ধরা দেয়, আবার কখনও দেয় না।
তবে আমার মনে হয় সুখি হওয়ার প্রধান উপায়টি হলো, আপনি যদি সুখি হতে চান, তাহলে মনকে নিজের ভুল মেনে নিতে শেখান। আমাদের চারপাশের যত কিছু ভুল আমরা রোজ দেখি, অন্যের যত ভুল ধরি, তার থেকে নিজের পাঁচ ভাগ ভুলও যদি আমরা মেনে নিতাম তাহলে ‘কেউ কেউ’ নয়, বীরবলকে মিথ্যে প্রমাণ করে অসংখ্য মানুষ সুখি হয়ে যেতাম।
চলুন, আজ থেকে তবে মনকে নিজের ভুল মেনে নিতে শেখাতে শুরু করি। দেখবেন। জীবনে আপনি কতটা যে সুখী…