উৎসবপ্রিয় বাঙালীরা এ মাসে দুটা উৎসব উদযাপনের সুযোগ পেল। দুটা উৎসবেরই অভিধা হলো ‘সবচে বড় উৎসব’। একটি হলো বৈশাখ মাসের ১ তারিখের উদযাপন, অন্যটি হলো শাওয়াল মাসের ১ তারিখের উদযাপন। একটি পয়লা বৈশাখ, অন্যটি পবিত্র ঈদুল ফিতর। প্রথমটি বাঙালীর সর্বজনীন উৎসব, অপরটি বাঙালী মুসলমানের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। দুই উৎসবকে কেন্দ্র করেই ঘটে মানুষের মিলনমেলা। চলে নানান সুস্বাদু খাবারে মুখরোচক আয়োজন, চলে নতুন নতুন পোশাক কেনার পালা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে উৎসব মানেই একটা খরুচে ব্যাপার। উৎসবের আরও একটা মানে আছে- সে হলো নিজের অর্থনৈতিক সঙ্গতিকে অতিক্রম করা।
এসব আয়োজনে বাঙালীর ওপর একটা অর্থনৈতিক চাপ পড়েছে। এই চাপটা সবচেয়ে বেশি পড়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ওপর। অর্থনীতির এই চাপ আগেও ছিল। তবে সেটি এখনকার মতো এতটা প্রকট ছিল না। ছিল শুধুই আনন্দ উদযাপনের দিন- হোক সে পয়লা বৈশাখ অথবা হোক ঈদুল ফিতর। আমাদের সময় দুটা উৎসবই ছিল বাঙালীর উৎসব। তখন পয়লা বৈশাখকে হিন্দুদের উৎসব কিংবা পূজা আখ্যা দিয়ে কেউ চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলত না। কেননা সেসময়ের মানুষেরা লেখাপড়া করতেন কেবল কেবল পরিক্ষায় পাশ করতে নয়, করতেন শিক্ষিত হয়ে উঠতে। তেমনি ঈদ উৎসবও মুসলমানদের হয়েও কেবল মুসলমানদের ছিল না। আমাদের ভিন্ন ধর্মীয় বন্ধু-প্রতিবেশীও আমাদের সঙ্গে যোগ দিন আনন্দ আয়োজনে। কেননা ছেলেবেলায় আমরা যে সমাজ দেখেছি সে সমাজে হিংসা-দ্বেষ-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতার কোনো জায়গা ছিল না। ছিল না বিত্তের চমক, ফলে বিত্ত নিয়ে প্রতিযোগিতাও ছিল না। ছিল সহনশীলতা, ছিল পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। আমরা অন্যকে খাটো করে আরেকজনে নিজেকে জাহির করতে দেখি নি। আমরা দেখেছি সকলে সকলকে সন্মান করছে। আমরা শিখেছি, দেখা হলেই সালাম দিয়ে কুশলাদি জানতে চাইতে হয়।
এখন নাকি এক পাড়াতে থেকেও কেউ কাউকে চেনে না। আগে যেখানে একটা বা দুটা পরিবার থাকত, সেখানে এখন বিশাল ভবন তুলে বিশ পঁচিশটা পরিবার থাকছে। তাই কেউ কাউকে চিনবে সে প্রত্যাশাটুকুও বাতুলতা হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ নেই। তাদের দিন কাটে ঘরে নয়ত কোচিং সেন্টারে। দেশের মানুষের নাকি আর্থিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে। হয়ত সেকারণেই তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। আগে যেটা কিনতে বিশ টাকা খরচ করতে হতো- এখন সেটা কিনতে লাগে একশ’ টাকা। ফলে আয় যা-ই হোক ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থানটির দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন ঘটে নি আসলে। করোনার মহামারীর আগে এক ডলারে দেশে মিলত আশি টাকা। এখন একশ; চোদ্দ টাকা। তবুও ঈদ আসে। তবুও ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাস আসে। মানুষ উৎফুল্লচিত্তে অনাড়ম্বরভাবেই নীরবে ঈদ উৎসবে শামিল হতে নিজেকে প্রস্তুত করে। কেননা যুগ যুগ ধরে আমরা বংশ পম্পরায় জেনে এসেছি ঈদুল ফিতর আমাদের মাঝে সাম্য, ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তাই নিয়ে আসে।
আমাদের ছেলেবেলায় আমরা বছরে দু বার নতুন পোশাক কিনতে পেতাম- সেটা দুই ঈদে। অনেক সময়ই আমরা জানতেও পেতাম না এবারে কোন্ পোশাকটি আমরা কিনতে পাব। আমাদের পোশাক হয় বাবা কিনে আনতেন নয়ত আমরা। আম্মাই কিনতেন বেশিরভাগ সময়। সে নতুন পোশাক নিয়ে আমাদের ভেতরে সে কি উত্তেজনা! রাতে নতুন পোশাক বালিসের পাশে রেখে ঘুমাতে যেতাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে আম্মা জাগিয়ে দিতেন। আমরা গোসল সেরে নতুন পোশাক পরে আব্বার সঙ্গে যেতাম ঈদের জামাত পড়তে। নামাজ শেষে কোলাকুলি। অনেক বেলা গড়িয়ে যেত কিন্তু আমাদের কোলাকুলি ফুরতো না। সে কোলাকুলিতে আমরা আনন্দ পেতাম। সে এক ভিন্ন আমেজের আনন্দ- বলে বোঝানো যাবে না।
এখনও ঈদে আমরা একসঙ্গে জামাত পড়ি, কোলাকুলিও করি, কিন্তু সে ভিন্ন মাত্রার আমেজটি যেন হারিয়ে গেছে! একি শুধুই সময় অতিক্রান্তের ব্যাপার? না অন্যকিছু?
শুরুতে বলেছিলাম, উৎসব মানেই একটা খরুচে ব্যাপার। উৎসবের আরও একটা মানে আছে- সে হলো নিজের অর্থনৈতিক সঙ্গতিকে অতিক্রম করা। এই যে মনে হওয়াটা, এইটিই উৎসব উদযাপনের প্রধান অন্তরায়। খরুচে ব্যাপার মানে হলো আপনি যা কিনতে চান বা আপনার সন্তানরা যেটি নেবে বলে বায়না ধরল, সেটির দাম পরিশোধ করতে গিয়ে আপনি দেখলেন আপনাকে আপনার অর্থনৈতিক সঙ্গতিকে অতিক্রম করতে হচ্ছে। আপনি সেটির দাম পরিশোধ করতে পারার মতো আয় করেন না। অথচ পদ্ধতিগত ভাবে আপনার আয় ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে। একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি হলো মধ্যবিত্ত। সরকার যখন বাজেট ঘোষণা করে, উচ্চবিত্তদের জন্যে বড় আকারের ফ্ল্যাট নিবন্ধনে খরচ কমিয়ে দেয়। আর মধ্যবিত্তের জন্যে? হ্যাঁ, মধ্যবিত্তের জন্যেও থাকে বটে। সে ঘোষণায় দাম কমে পাউরুটির। স্যান্ডেলের দামও কমায়। তারা দুপুরে ভাত না খেয়ে পাউরুটি খেয়ে বাস ভাড়া বাঁচাতে হেঁটে বাড়ি ফিরবে।
গত বছরে (২০২২) বাজেট ঘোষণার পর বাজেট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বাজেটের চাপটা সৃষ্টি হচ্ছে আইন মেনে চলা সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তের ওপর, কিন্তু শতকরা যে দশ ভাগের কাছে জিডিপির, দেশের মোট সম্পদের ৮০ ভাগ আছে, তারা কিন্তু চাপ বোধ করেন না, (একাত্তর টেলিভিশন ৯.৬.২০২২)।
‘জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী এখন ব্যয় বেশি। এই ব্যয় মেটানোর আয় নেই মানুষের। আর মধ্যবিত্তরা তো আছেন মহাবিপদে। তারা কোথাও যেতেও পারেন না। বাসায় ভালো খেতেও পারেন না। এ কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষের আয় বাড়াতে হবে। নিত্যপণ্যের দাম রাখতে হবে নিয়ন্ত্রণে।’
ওপরের ওই কথাটি আমি বললে কেউ পাত্তা দেবেন না বলে বলি নি। ও কথাটি তাই আমার নয় ওইটি বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।