“যুদ্ধজয় আর মানবতার পরাজয়”

0 comments 47 views 5 minutes read

সভ্যতা ও যুদ্ধ একই বয়সি। পৃথিবী কখনও যুদ্ধহীন ছিল না। সাধারণ ভাবে দুটি দেশের সশস্ত্র সংঘর্ষই হলো যুদ্ধ। যুদ্ধ কখনোই কেবল সীমান্তের গোলাগুলি নয়; এটি রাজনীতি, ক্ষমতা আর জাতীয়তাবাদের মুখোশে লুকিয়ে থাকা মানবিক বিপর্যয়। রাষ্ট্রের ওপর আধিপত্য বা রাজনৈতিক পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া ও সেটা প্রতিহত করাই যুদ্ধের কারণ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দশকের দ্বন্দ্ব ও তিনটি বড় যুদ্ধ আমাদের এমন এক ইতিহাসের দিকে নিয়ে যায়, যেখানে ‘জয়’ মানে শুধু পতাকা ওড়ানো নয়, বরং হাজার হাজার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিজয় মঞ্চ। যুদ্ধ প্রধানত সাধারণ মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।

ইতিহাসের ছায়া
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার ফলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তারপর থেকে দুটি দেশের মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধ হয়। তারমধ্যে সব যুদ্ধই কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে। দেশভাগের পরপরই ১৯৪৭-৪৮ সালে প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। এটি কাশ্মীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। তখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। পরে খুব দ্রুত উভয় দেশের সশস্ত্রবাহিনীও জড়িয়ে পড়ে। এরপর ‘কচ্ছ’ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দেশ দুটি। সেসময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন দেশ দু’টিকে সংঘর্ষ বন্ধ করতে রাজি করান।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আবারও মুখোমুখি হয় ভারত-পাকিস্তান। একটা দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৯ সালে শুরু হয় কারগিল যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধের পরে পাকিস্তান এ যুদ্ধের দায় সম্পূর্ণ কাশ্মীরি স্বাধীনতাপন্থী জঙ্গিদের ওপর চাপিয়ে দেয়। তবে পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনীও এ যুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। শেষে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমর্থনের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পাকিস্তানকে ফৌজ প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। সীমিত সময়ের হলেও তার কূটনৈতিক ও সামরিক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। প্রতিটি যুদ্ধেই মারা গিয়েছে হাজার হাজার সৈনিক, ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য পরিবার, এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলো দাবি করে ‘জাতীয় গৌরব’।

যুদ্ধে লাভ কাদের?

সাধারণ মানুষ কখনও যুদ্ধ চায় না। যুদ্ধ যারা চায়, ;আভ তাদেরই। যুদ্ধের সরাসরি লাভ যারা পায়, তারা বেশিরভাগ সময় মাঠে থাকে না।
* রাজনৈতিক শক্তি: যুদ্ধের উত্তেজনা ব্যবহার করে তারা জনমত নিজেদের পক্ষে ঘুরিয়ে নেয়। জাতীয়তাবাদের ঢেউ তুলে সমালোচনার মুখে তালা লাগিয়ে দেওয়া যায়।
* অস্ত্র নির্মাতা ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকরা: যুদ্ধ মানেই নতুন চুক্তি, নতুন বিক্রি। কোটি কোটি ডলারের অস্ত্রের বাণিজ্য গতি পায়।
* মিডিয়া: সেনাবাহিনীর গর্বগাথা, শত্রু রাষ্ট্রের নিন্দা—এসবই বাড়িয়ে তোলে ভিউ, ট্রাফিক, রেটিং।

যুদ্ধে লোকসান
যুদ্ধে লোকসানটা শুধু তাদেরই – যারা যুদ্ধের শিকার, সেই সাধারণ মানুষদেরই। যুদ্ধের খরচটাও দেয় সাধারণ মানুষ।
* সৈনিক ও তাদের পরিবার: যারা প্রাণ দেয়, তাদের মুখে দেশের জন্য গর্ব থাকলেও—পেছনে থেকে যায় অসংখ্য ভাঙা পরিবার, শোকগ্রস্ত মা, বিধবা স্ত্রী ও পিতৃহীন সন্তান।
* সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ: যুদ্ধ মানে তাদের জন্য বাস্তুচ্যুতি, অর্থনৈতিক ধ্বংস, এবং চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা।
* মানবিক সম্পর্ক: ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস—সব মিলিয়ে অনেক সম্পর্ক ছিল একসময় দুই দেশের মানুষের মাঝে। যুদ্ধ সেই সম্পর্কগুলিকে শত্রুতায় রূপ দেয়।

লাশের হিসাব কি শুধু সংখ্যা?

১৯৭১ সালের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের ৯০ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। ভারত-পাকিস্তান উভয় পক্ষেই প্রাণহানির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এই লাশগুলো কি শুধু সংখ্যা? প্রতিটি লাশের পেছনে থাকে একেকটি গল্প—স্বপ্ন, সম্পর্ক, ভবিষ্যৎ। যুদ্ধ শেষ হয় একদিন, কিন্তু লাশের শোক দীর্ঘস্থায়ী হয়। বেঁচে থাকা মানুষগুলো প্রতিদিন যুদ্ধের ভার বহন করে চলে।

উপসংহার

এখনও যখন রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ে, কেউ কেউ যুদ্ধকে উৎসবের মতো দেখাতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো—যুদ্ধে কারও প্রকৃত বিজয় নেই, আছে কেবল পুড়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ। যুদ্ধ যদি কিছু শেখায়, তা হলো— লাশের ওপর দাঁড়ানো কোনো ‘জয়’ আসলে পরাজয়েরই আরেক নাম। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষকে শান্তির পক্ষে সোচ্চার হতে হবে। বিদ্যমান যে কোনও সমস্যারই শান্তিপূর্ণ সমাধান আলোচনা দিয়েই সম্ভব। যুদ্ধ কখনও শান্তি আনে না।

প্রশ্ন থেকে যায়— আমরা কি এই সত্য স্বীকারে প্রস্তুত?

ভালো থাকবেন🤗ভালোবাসবেন।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing