আবদুল ওয়াহিদ ভাট মারা গেছেন। আবদুল ওয়াহিদ ভাট জন্মেছিলেন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের খানিয়ারে। কিন্তু মারা গেলেন ‘পাকিস্তানি’ পরিচয় নিয়ে। ভারতের প্রশাসন দাবি করেছে আবদুল ওয়াহিদ ভাট পাকিস্তানের নাগরিক। কি নিষ্ঠুর পরিহাস!
আবদুল ওয়াহিদ ভাটের বয়স ৮০ বছর। জন্ম ও কাশ্মীরের বেড়ে ওঠা খানিয়ার গ্রামে। পুরো জীবনটা ওই ভূখণ্ডেই কাটিয়েছেন। তিনি ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান নি। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে অস্বীকার করেছে।
পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডে তিনি নিহত হন—না, তাঁর মৃত্যু কেবলই আরেকটি সংখ্যা নয়। তাঁর মৃত্যু দিয়ে সামনে আসে রাষ্ট্রের রাজনীতির নগ্নতম রূপ। ভারতের মাটিতে জন্ম নেওয়া এই মানুষটিকে ‘পাকিস্তানের নাগরিক বলে চিহ্নিত করে রাষ্ট্র।
দেশ ও রাষ্ট্র যদি তার সন্তানের ভুল পরিচয় নির্মাণ, তাহলে নাগরিক কার কাছে যাবে?
‘পরিচয়’: রাজনীতির সবচেয়ে নীরব অস্ত্র
বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় পরিচয় কেবল পাসপোর্ট বা আধার কার্ডে সীমাবদ্ধ নয়। এটি হয়ে উঠেছে শাসকের অন্যতম একটি হাতিয়ার। আজ যে মুসলমান, যে কাশ্মীরি, তার পরিচয় বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমনকি নিজ দেশে থাকার জন্যও প্রমাণপত্র দেখাতে হয়।
আবদুল ওয়াহিদ ভাট কোনো জঙ্গি ছিলেন না, কোনো আন্দোলনকারী নন তিনি, এমনকি নন সামাজিককর্মী। তিনি খুব সাধারণ একজন মানুষ, বয়স যার আশি বছর। যিনি রাষ্ট্রের ছায়ায় মর্যাদার শেষ দিনগুলো কাটানোর কথা ভেবেছিলেন। অথচ তাঁকে শেষ বিদায় দিতে হয়েছে অপমানের ঘেরাটোপে, একটি ভুল পরিচয়ে।
❝রাষ্ট্র যখন ভুল করে, নাগরিক মর্যাদা খসে পড়ে❞
ভারত যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় তবে—এই মৃত্যুর দায় কার? কাশ্মীরের মানুষকে যদি ভারতেরই নাগরিক ধরা হয়, তবে কেন এই পরিচয় নিয়ে এই প্রতারণা? যদি না ধরা হয়, তবে কি আমরা অঘোষিতভাবেই স্বীকার করে নিচ্ছি—কাশ্মীরের মাটি ও মানুষ এখনো ‘পর’?
রাষ্ট্রীয় চিত্রনাট্যে ভুল চরিত্র বসালে শুধু ইতিহাস বিকৃত হয় না, মানুষ হারায় আত্মপরিচয়ের মর্যাদা। জন্মভূমির কাছে প্রাপ্তি ছিল জীবন ও পরিচয়ের শুধু স্বীকৃতি, আর পেল রাষ্ট্রচ্যুতি!
আবদুল ওয়াহিদ ভাটের মৃত্যু যেন সেই পুরনো কবিতার প্রতিধ্বনি—
“এই মাটি আমার, তবু আমি তার নই; এই বাতাস চিনি, তবু নিশ্বাসে বাধা পড়ে।”
এটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অসংবেদনশীলতার প্রতীক। যেখানে নাগরিকত্বের শংসাপত্রই হয় বেঁচে থাকার একমাত্র অধিকারপত্র, সেখানে মানবতা নিঃশব্দে ঝরে পড়ে।
এই মৃত্যু একা নয়। এর প্রতিধ্বনি প্রতিদিন শোনা যায় সীমান্তে, দলিলঘরে, পরিচয়পত্রের লাইনে, বা সোশ্যাল মিডিয়ার নিশ্চুপ পোস্টে। রাষ্ট্র যদি একদিন ভুলে যায়, কে তার, কে নয়।তবে নাগরিকের একমাত্র হাতিয়ার হয় লেখা, প্রতিবাদ, ও স্মৃতি।
আবদুল ওয়াহিদ ভাট আজ আমাদের নাগরিক চেতনার আয়নায় এক বড় প্রশ্নচিহ্ন।
ভালো থাকবেন ভালোবাসবেন।