ভারত ও হিন্দুত্ববাদ: একটি রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের অনুধ্যান

0 comments 49 views 5 minutes read

ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, এবং সাম্যের ভিত্তিতে। ১৯৫০ সালে গৃহীত সংবিধানে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
তবে বিগত এক দশকে ভারতীয় রাজনীতির যে রূপান্তর আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তা এই ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিকে গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে।

আমার ব্যক্তিগত মত অনুযায়ী, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বে অভিষেকের পর থেকেই ভারত রাষ্ট্র একটি স্পষ্ট হিন্দুত্ববাদী অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।

হিন্দুত্ববাদের শিকড় ও আধুনিক পুনর্জাগরণ
হিন্দুত্ব একটি ধর্ম নয়, বরং একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ—যা ১৯২৩ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের “Hindutva: Who is a Hindu?” গ্রন্থে প্রথম সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়। এই মতবাদকে ভিত্তি করে ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS), যা ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP)-র আদর্শিক মূলভিত্তি।

অতীতে হিন্দুত্ব একটি পরিসীমিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন সেই আদর্শ প্রথমবার সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে আসে।

রাষ্ট্রীয় নীতিতে হিন্দুত্ববাদের প্রতিফলন
নরেন্দ্র মোদির আমলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ, যা আমার দৃষ্টিতে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে এসে হিন্দুত্ববাদী চরিত্র গ্রহণের দিকনির্দেশ দেয়, তা হল:
• গরু রক্ষা ও গোরক্ষা দল: গরু সংক্রান্ত ‘সেন্টিমেন্ট’ ব্যবহার করে বহু রাজ্যে মুসলিম ও দলিত জনগণের উপর হিংসাত্মক হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাগুলো অনেক সময় ‘মব লিঞ্চিং’-এ রূপ নেয়, যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কখনো সরাসরি নিন্দা জানায়নি।
• CAA ও NRC আইন: ২০১৯ সালে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA), যা বিশেষভাবে মুসলিমদের বাদ দিয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ভারতের নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়, তা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
• ধর্মীয় উৎসব ও ভাষা রাজনীতি: রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে হিন্দির একমাত্রীকরণ, পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের পুনর্লিখন, এবং শুধুমাত্র হিন্দু উৎসব ও মূল্যবোধের উপর রাষ্ট্রীয় জোর—এসবই একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়।
• কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ: যদিও এটি একটি জটিল ও বহুস্তরীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তথাপি এর পিছনে একধরনের “রাষ্ট্রীয় এককরণ” ভাবনা কাজ করেছে, যা আঞ্চলিক পরিচয় ও সংবিধান প্রদত্ত স্বাতন্ত্র্যের বিপরীতে দাঁড়ায়।

গণমাধ্যম, শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ
এই সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম প্রায় বিলুপ্তির পথে, এবং “Godi Media” শব্দটি ভারতীয় জনপ্রিয় অভিধানে জায়গা করে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যারা সরকারের সমালোচনা করে, তারা “দেশদ্রোহী” আখ্যা পায়।

ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও উদ্বেগ
আমি মনে করি, ভারত তার রাষ্ট্রীয় চরিত্রে একটি বিপজ্জনক বাঁক নিচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, সংবিধান প্রদত্ত সমতার জায়গায় “আমরা বনাম ওরা”র রাজনীতি, এবং একটি বহু বৈচিত্র্যময় জাতিকে একমাত্রিক ধর্মীয় ছাঁচে ফেলার প্রচেষ্টা—এসবই রাষ্ট্রের জন্য অশুভ বার্তা।

ভারতের প্রকৃত শক্তি তার বৈচিত্র্য ও সহাবস্থানে। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, আদিবাসী—এদের সম্মিলিত অস্তিত্বই ভারতের আসল পরিচয়। সেই পরিচয় যদি ক্রমশ মুছে ফেলা হয়, তবে তা কেবল সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, গোটা রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।

উপসংহার
হিন্দুত্ববাদ একটি রাজনৈতিক দর্শন যা একটি রাষ্ট্রকে একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে তুলতে চায়। ভারতের আত্মা বরাবরই বহুত্ববাদী, সমন্বয়মুখী, এবং উদার।
আমার বিশ্বাস, ইতিহাস এই সময়কে মনে রাখবে এক সন্ধিক্ষণ হিসেবে—যেখানে ভারত কোন পথে যাবে, তা ঠিক হবে জনগণের মনন ও বিবেকের উপর ভিত্তি করে।

ভালো থাকবেন, ভালোবাসবেন।

(একটি ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে)

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing