বিপ্লব: স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ

0 comment 73 views

বাংলাদেশের বুকে কয়েকটি দগদগে ক্ষত রয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতটি তৈরি হয়েছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে। এর প্রায় আড়াই মাসের মাথায় পরপর দুটা ক্ষত তৈরি হয়েছিল – একটি ৩ নভেম্বর, অপরটি ৭ নভেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিন দুটি অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের দিন বলে পরিচিতি পেয়েছে। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর  বিভাজনের তিনটি মোটা দাগ টেনে দিয়েছিল।  এক পক্ষ দিনটি মহাসমারোহে ‘সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে পালন করে। আরেক পক্ষ খুব আড়ম্বরে উদযাপন করে ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস।’ আবার অনেকেই দিনটিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। একে অবলম্বন করে পরবর্তীতে সূক্ষ্ণ আর সরু আরও কিছু রেখা টানা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালেই সেসব দাগ দেখতে পাওয়া যাবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় চার নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশটাকে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল ক্ষমতা দখলকারীরা। আর ৭ নভেম্বর সে হাঁটার গতিতে আরও গতির সঞ্চার করেছিল। একাত্তরের আগে বাংলাদেশ যে তিমিরে ছিল, তারা দেশটাকে নিয়ে সে তিমিরের দিকেই রওনা করেছিল। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীরা নিজেদের বৈধ করতে ধর্মকে ঢাল বানালো। উস্কে দিল সাম্প্রদায়িক বিভক্তি। বাংলাদেশে ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগল রাজনৈতিক বিদ্বেষ।

১৫ আগস্টের মতো ৩ আর ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের দু’টি মাইলস্টোন। দুঃখজনকভাবে এ তিনটি মাইলস্টোনই কালো পাথর দিয়ে গড়া। পঁচাত্তরের আগস্ট আর নভেম্বর মিলেমিশে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিরাট শূন্যতার তৈরি করেছিল, এই এতগুলো বছর পেরুলেও সে শূন্যতা পূরণ হয়েছে বলা যাবে না। আজ দেশে যে হিংসার রাজনীতি দানবের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার বীজ রোপিত হয়েছে পঁচাত্তরের আগস্ট-নভেম্বরের মধ্য দিয়েই।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনী প্রধান হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৩ নভেম্বর এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিয়াকে  ক্ষমতাচ্যুত করে বন্দি করেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। এর চারদিন পর ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহের জাসদের গণবাহিনী ও সৈনিক সংস্থাকে নিয়ে ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ নামে পাল্টা এক অভ্যুত্থানে মুক্ত করে জেনারেল জিয়াকে। ছেচল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এ ‘বিপ্লব’ আসলে কেমন ‘বিপ্লব’ এর  সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা  আজও পাওয়া যায় নি। অথচ ইতিহাসের স্বার্থেই এই সত্য উদঘাটিত হওয়া খুব করে দরকার।

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গী  কর্নেল শাফায়াত জামিল বলেছেন, ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা করা; সংবিধান লঙ্ঘন করে যে অবৈধ খুনি সরকার দেশ ও জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল তার অপসারণ করা। একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে গঠিত অন্তর্বতীকালীন একটি সরকারের মাধ্যমে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। আরও অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ ছিল যে মুক্তিযুদ্ধকালীন খন্দকার মোশতাকের যড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিষয়ে আমরা স¤পূর্ণ অবহিত ছিলাম। তাই তীর হাতে রক্তস্নাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মোটেও নিরাপদ ছিল না। পাকিস্তানের সঙ্গে তার তথাকথিত কনফেডারেশনের চক্রান্ত নস্যাৎ করতে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তার অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

অন্যদিকে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানটির অবস্থান ছিল এর বিপরীতে। এই অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেন কর্নেল তাহের ও জাসদ। তবে কর্নেল তাহের জিয়াকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ৭ নভেম্বরের পাল্টা ক্যু ঘটান নি। বস্তুত তাহের জিয়াকে নিজের সহযোগী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল জিয়া মুক্ত হয়েই তাহেরকে পিঠ দেখান বলে সেসময়ের জাসদ নেতাদের নানান বক্তব্য আর লেখালেখিতে পাওয়া যায়।

জাসদের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের বিপরীত চিন্তার মানুষ পাকিস্তানি দর্শনে বিশ্বাসী জিয়াউর রহমানের হাতে নিজেদের অজান্তেই যেন ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল জাসদ। কিন্তু জিয়া ’৭৫-এর ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেন। ’৭৬-এর ২১ জুলাই গোপন আদালতে এক প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়  কর্নেল তাহেরের। অথচ কর্নেল তাহের এই ‘দেশদ্রোহিতা’ করেছিলেন বলেই জিয়া মুক্ত হয়েছিলেন।

শেষ কথাটা কলামিস্ট সোহরাব হোসেন থেকে ধার করে বলি, ‘১৯৭৫ সালের সাত নভেম্বর যারা সিপাহী বিপ্লব করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে ‘তাহের হত্যাকারী’ জিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে এখন আওয়ামী লীগের কিংবা বিএনপির সঙ্গে নিজেদের ভাগ্য বেঁধে ফেলেছেন। বিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পেছনে ফেলে ক্ষমতার হিস্যা নিতেই তারা এ দলে ও দলে ভাগ হয়ে আছেন। কিন্তু তাঁদের তাত্তি¡ক গুরু সিরাজুল আলম খান পাঁচশ’ আসনের সংসদ নিয়ে বেশ কিছু কাল হৈচৈ করে এখন রাজনীতি থেকে পুরোপুরি ‘অবসর’ নিয়েছেন।’

প্রকাশকাল: অনুস্বর, নভেম্বর ২০২১।

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing