88
জলের অত্যধিক প্রবাহে যখন শুকনো জায়গা প্লাবিত হয় সাধারণ অর্থে সেটিই হলো বন্যা। সাধারণ লোকজন যারা পরিবেশবিদ নন তারা তো এভাবেই বন্যাকে সংজ্ঞায়িত করবেন। বন্যা তো আসলে জলবিদ্যার পড়াশুনার ক্ষেত্র। আমাদের মতো যাদের এই পড়াশুনাটা নেই কিন্তু বন্যাকে এড়িয়ে যারা পারি না, কিংবা ওর আক্রমণের শিকার না হয়ে উপায় থাকে না, অথচ সারাজীবন ধরে বন্যাকে দেখে আসতে থাকলেও এর চরিত্র মেজাজ বা ইচ্ছা কিছুই জানতে পারি নি, আমরা । তার পরিচয়টি এভাবেই দেব! তবে জলবিদ্যা জানাচ্ছে, কৃষি, পুরকৌশল ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বন্যা খুবই উদ্বেগের বিষয়।
জলবিদ্যা এইখানে আমাদের বিদ্যাটিই বলছে আসলে। এখন আমেরিকায় থাকলেও আমি তো নদীর দেশেই মানুষ । ছেলেবেলা থেকেই আমরা বন্যা দেখতে দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি। বর্ষাকাল এলেই ঘোর বর্ষায় পুরো অঞ্চল বন্যায় তলিয়ে যেত। এখন বর্ষাকাল জুন-জুলাইয়ে হলেও ১৭৮৭ সালে মার্চ থেকেই ঢাকা শহরে ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল । সে বৃষ্টি চলেছিল টানা তিন মাস একেবারে জুলাই অবধি। টানা এই বৃষ্টির ফলে নদ-নদীর পানি ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়ে বন্যা শুরু হয়ে গিয়েছিল । ইতিহাসবিদ যতীন্দ্রমোহন রায় বলেছেন, ঢাকা শহরের চেহারা তখন নাকি প্রায় ইটালির ভেনিস নগরীর মতো হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভেনিস নগরীর সঙ্গে মিলটি কেবলই জলমগ্নতায়। ভেনিসের রোমান্টিকতা কিংবা সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্রও সেসময়ের বন্যা কবলিত বিধ্বস্ত ঢাকা শহরের ছিল না।
২৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও বর্ষাকালের হাত ধরে বন্যা আসে ঢাকায়, আসে পুরো দেশজুড়েই। কিন্তু এখন উন্নয়নের T ঢাকাকে ভেনিসের সঙ্গে তুলনা করা যায় কিনা জানি না তবে বৃষ্টি এলে জলাবদ্ধতা হয় জানি। পুরো বর্ষাকাল জুড়েই ঢাকার নাগরিকেরা জলাবদ্ধতায় অতিষ্ঠ থাকেন। এ বছর অবশ্য সিলেট ডুবেছে। বিদেশে থাকার ফলে সিলেট অঞ্চল ইটালির ভেনিসের মতো দেখতে হয়েছে কিনা জানি না, তবে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে সিলেট তার বন্যা নিয়ে শিরোনাম হয়েছে। গেল ১২২ বছরে ওই অঞ্চলের মানুষ এমন বন্যা দেখে নি । টানা বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণায়। জলবন্দি হয়ে পড়েছিলেন দশ লাখ মানুষ। তিন শ’র বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। বন্ধ করা হয়েছে এ অঞ্চলের একমাত্র বিমানবন্দর এম এ জি ওসমানি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ।
আমি এখন দেশ থেকে অনেক অনেক দূর। তৃতীয় বিশ্ব থেকে সুদূরে এই প্রথম বিশ্বের উন্নত আমেরিকাতে এসেও দেখছি বন্যা পিছু ছাড়ে নি। এইত তো এই সেদিনও কেনটাকিতে বন্যায় ২৫ জন মানুষ মারা গেছেন। এই ২৫ জনের ৪ জন আবার শিশু । খবরের কাগজ জানিয়েছে, বন্যার তোড়ে মানুষের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। ভেঙেছে নদীর পাড়। এমনিতে খাড়া পাহাড় আর সরু উপত্যকার কারণে কেনটাকিতে বন্যার প্রবণতা বেশি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এবারের ভয়াবহ বন্যার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকেও দায়ী করছেন।
কয়েক বছর আগে হিউস্টনে বন্যা হলো। পূর্ব টেক্সাসের কালো মাটিতে ফসল জন্মে খুব সহজে। এখানকার পর্বতমালার অবদান হচ্ছে কয়লা, পানিশক্তি আর উর্বর উপত্যকা। আমেরিকার বৃহত্তম তেলক্ষেত্রগুলোর কয়েকটি অবস্থিত টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে। টেক্সাসের হিউস্টন জায়গাটা হলো আমেরিকার চতুর্থ বৃহত্তম এবং টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের বৃহত্তম শহর শহর। ২০১৭ সালের এই প্রলয়ঙ্করী বন্যা আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঝড় আর তার ফলে সৃষ্ট বৃষ্টিপাত থেকেই আবির্ভূত হয়েছিল। সেবারে হিউস্টনে তিরিশ ইঞ্চিরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়। তখন ১৯টি কাউন্টির জন্যে ফেডারেল দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়। দুর্যোগের ফলে টেক্সাসের প্রায় আড়াইশ’র বেশি সড়ক ও মোটর যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
গেল বছরের জুলাইতে আমাদের এই নিউ ইয়র্কেই হঠাৎ বন্যা শুরু হলো। খবরের কাগজগুলো লিখল ‘আকস্মিক বন্যা’ । জানা গেল, ঘূর্ণিঝড় এলসার প্রভাবে এই হঠাৎ বন্যা। শুধু নিউ ইয়র্কে নয়, আমেরিকার বিভিন্ন শহরেই এই আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছিল। প্রবল বৃষ্টি আর ঝড়ে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছিলাম। কয়েক হাজার বাড়িঘরের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে সেখানকার মানুষগুলো অন্ধকারে অসহায় দিন কাটাতে লাগল। সাবওয়েগুলোতে বন্যার পানি থৈ-থৈ করতে লাগল। শহর কর্তৃপক্ষ ট্রেনের গতিপথ পাল্টে দিতে বাধ্য হলো।
পরের মাসে সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ বন্যায় আবারও ডুবল নিউ ইয়র্ক। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে নিউ ইয়র্ক। এবারে ঘূর্ণিঝড় আইডার প্রভাব। নিউ ইয়র্ক একলা নয়, সঙ্গে নিউ জার্সিও ডুবেছে বন্যায়। এই দু শহরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো। বাড়ির বাড়ির বেজমেন্ট পানিতে ভরে গেল। রাস্তা দিয়ে বয়ে চলা বন্যার প্রবল স্রোতে গাড়ি ভেসে যেতে লাগল । মনে আছে, টেলভিশনের খবরে দেখিয়েছিল, একটা গাড়ি থেকে এক লোককে উদ্ধার করা হয়েছিল । সাবওয়ে স্টেশনগুলোতে পানি ঢুকে গেল । নিউ ইয়র্কের সেসময়ের মেয়র রেসিও এই বন্যাকে ‘ঐতিহাসিক আবহাওয়া দুর্যোগ’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
উনিশ শতকের আমেরিকান ইতিহাসবিদ ফ্রেডারিক জ্যাকসন টার্নার বলেছেন, ‘বিস্তীর্ণ অবাধ সমতল ভূমি, এর অব্যাহত বিস্তৃতি এবং পশ্চিমে আমেরিকানদের বসতি-বিস্তার-এসবই আমেরিকার অগ্রগতির কারণ।’ এই বলে দেয়ায় টার্নার সাহেব কি অহংকার জানাচ্ছেন? একটু নির্দোষ অহংকার আছে বোধহয় । কেননা ‘আমি উন্নত’ দাবিটির সঙ্গে অন্যকে খাটো করবার একটা প্রচেষ্টা রয়ে যায়, সেটি সুপ্তভাবে হলেও। আসলে ব্যাপারটা হলো প্রকৃতির কাছে মানুষ অসহায়। প্রকৃতিকে জয় করেছে বলে মানুষ যে অহংকার করে, সেটি আসলে ভান। কেননা তাকে বেঁচে থাকতে হয় প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই।
সেকারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে তার প্রতিরোধে এই আধুনিক যুগেও মানুষের কিছুই করবার থাকে না। কিন্তু মানুষ তো এই প্রকৃতিরই সৃষ্টি। প্রকৃতি তার সকল সন্তানকে যা যা দিয়েছে, মানুষকে দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। মানুষ তাই খুব করে অহংকারে নিজেকে সৃষ্টির সেরা বলে দাবি করে চলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সৃষ্টির সেরা হলে যে কাজ করতে হয় সে কাজ কি মানুষ করছে?
এই যে কেন্টাকির ভয়াবহ বন্যা এসে ২১ জন মানুষের আর ৪ জন শিশুকে মেরে ফেলল, বিশেষজ্ঞরা বললেন, এর জন্যে জলবায়ুর পরিবর্তন দায়ী । তো জলবায়ুর এই পরিবর্তনে কি মানুষের ভূমিকা নেই? আছে তো। বেশ ভালোভাবেই আছে। মানুষ শিল্প, কলকারখানা, যানবাহন ইত্যাদি চালাতে বিপুল পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানী জ্বালাচ্ছে, কয়লা পোড়াচ্ছে, যার ফলে কার্বন মনাক্সোইড এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে মিশছে। গাছ পৃথিবীতে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং অক্সিজেনের ভারসাম্য বজায় রাখে জেনেও অবিবেচকের মতো গাছ কেটে ফেলছে। প্রচুর খনিজ তেল ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। দ্রুতহারে নগরায়ণের ফলে ইট, সিমেন্ট, পাথর, লোহার আচ্ছাদনের পরিমাণ বাড়ছে। এসব পদার্থ প্রচুর তাপ শোষণ ও বিকিরণ করে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে তুলছে। অত্যধিক দ্রুতহারে শিল্পায়ণের ফলে কলকারখানার ধোঁয়া ও আবর্জনার উৎপাদন হচ্ছে যা বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ ও দূষণ করার পাশাপাশি সমুদ্রকেও দূষিত করে তুলছে। ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বা সিএফসি হলো গ্রিনহাউস গ্যাস। এই গ্যাস রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদি অত্যধিক ব্যবহারে ওজোন স্তর ক্ষয়ে যাচ্ছে। এসব মিলিয়েই আজকে প্রকৃতি আর জলবায়ু বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
কেবল বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্বজুড়েই গেল কয়েক বছর ধরে প্রচণ্ড গরম অনুভূত হচ্ছে। বর্ষাকাল এসে যাই যাই করছে অথচ বৃষ্টির দেখা নেই। বৃষ্টিহীন খরতাপে পুড়ে চৌচির হচ্ছে মাটি কৃষক, শ্রমিক আর দিনমজুর আর মধ্যবিত্ত মানুষেরা দিশেহারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে। নিত্যই ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। খরা, অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির ফলে পৃথিবী ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। শীতে এশিয়া যখন জবুথবু, তখন দাবানলে দাউ দাউ জ্বলছে আমেরিকা ও ইউরোপ। পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় ক্রমাগত গলছে বরফ। বাংলাদেশে ফণী, আম্পান, আইলা ও নার্গিসসহ নানা দুর্যোগ । নদীতে বিলীন হচ্ছে বসত ও চাষের জমি। ঘরবাড়ি হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব ভূমিহীন হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বেড়েই চলেছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে পানির স্তর ক্রমাগত নীচে নেমে যাচ্ছে। পরিবেশগত সকল ব্যবস্থা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মানুষ যেন মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
না, যুদ্ধ কেবল প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়, এই রকমের বিপর্যয়েও উন্নত দেশের ভীষণ বুদ্ধিমান মানুষেরা নিজেরাও যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে আছে। সাম্প্রদায়িক বিভেদে মত্ত হয়ে মাথাচাড়া দিচ্ছে। অথচ পৃথিবীজুড়ে প্রায় তিন বছর ধরে একটা ভয়াবহ মহামারি যে চলমান সেদিকে তাদের লক্ষ্য নেই। আর আমরা তাদের পানে চেয়ে চেয়ে দেখতে দেখতে গুনগুনিয়ে বেসুরো গলায় সুর ভাঁজছি, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান- অথচ বর্ষাকাল প্রায় ফুরিয়ে এলেও শ্রাবণের যে দেখা নেই এইটিও উন্নত ও বুদ্ধিমান মানুষেরা বুঝতে পারছে না। প্রকৃতিকে জয় করতে গিয়ে মানুষ যে ভীষণভাবে পরাজিত হয়ে আছে সেটিও বুঝতে পারার মতো বোধটিও এই উন্নত ও বুদ্ধিমান মানুষেরা হারিয়ে ফেলেছে।