আপনারা কি জানেন পতাকা একটি স্ত্রী বাচক শব্দ? নদী মতোই। আমরা নদী ও নারীকে সমার্থক করে ফেলেছি। চাঁদ যেমন। ‘তুমি চাঁদের মতো সুন্দর’- কথাটি কেউ কখনও কোনো নারীকে বলতে শুনেছেন? মনে হয় না। আমিও শুনি নি।
সমাজটা যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক আর একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সঙ্গে প্রধানত পুরুষেরাই যুক্ত ছিলেন, সেকারণেই হয়ত নামগুলো স্ত্রী বাচক হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীর কোনো ভূমিকা ছিল না। অবশ্যই ছিল। বাস্তবতাটা হলো নারী যদি পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন-যুদ্ধে সমান ভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়তেন তাহলে কোনো আন্দোলন-যুদ্ধই সফল হতে পারত না। উত্তোলিত হতো না কোনো দেশের জাতীয় পতাকা।
আচ্ছা পতাকা কি? পতাকা কি শুধুই টুকরো কাপড়? এক টুকরো কাপড় তো বটেই কিন্তু শুধুই এক টুকরো কাপড় নয়। পতাকা হলো একটি জাতি ও দেশের প্রতীক। তাহলে স্ত্রী বাচক শব্দে নাম কেন রাখা হলো পতাকার? পরম মমতাময়ী ভীষণ ভালোবাসায় যেভাবে সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন, দেশ ও জাতির পতাকাও তার নাগরিককে সেভাবেই আগলে রাখবে- এমন বাসনাই স্ত্রী বাচক শব্দের ব্যবহার? এমন ভাবনা থেকেই কি দেশমাতৃকাকে মা সম্বোধনের প্রচলন?
পতাকা একটি দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের আদর্শ বহন করে। বহন করে ইতিহাস। যেমন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাটিতে গাঢ় সবুজ রঙের মাঝখানে রয়েছে টকটকে লাল রঙের একটি বৃত্ত। ওই সবুজ হলো বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি আর তারুণ্যের প্রতীক। মাঝখানের টকটকে লাল বৃত্তটি হলো উদীয়মান সূর্য, আবার আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছেন তাদের রক্তেরও প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের আগে এই লাল বৃত্তটির মাঝখানে বাংলাদেশের ভূখণ্ডটি আঁকা হতো। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত সে মানচিত্র রক্তের নিচে তলিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। সবুজ রঙ বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক, বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই উত্তোলনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো। সবুজ জমিনের লাল বৃত্তে আঁকা হলুদ মানচিত্রে সেই পতাকাই সেদিন বাঙালীকে বার্তা পৌঁছেছিল- অচিরেই স্বাধীন আমরা একটা দেশ পেতে যাচ্ছি। ঠিক এসব কারণেই পৃথিবীর সকল দেশেই পতাকার প্রতি সবসময় যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করবার আইন আছে।
আচ্ছা বলুন তো, সন্মান কিংবা শ্রদ্ধাবোধ কি আইন দিয়ে হয়? এও তো ভালোবাসারই আরেক রূপ, তাই নয়?
কিন্তু পতাকার প্রতি আমার কেন জানি একটা অদ্ভুত রকমের দুর্বলতা আছে। আমি যখন পতাকাকে হাওয়ায় পতপত করে উড়তে দেখি তখন আমার বুকের ভেতরটায় কেমন যেন করে ওঠে! সারাটা গায়ে একটা শিহরণের ঢেউ বয়ে যায়। আমি তখন সেই চারপাশ ভুলে পতাকার দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়েই থাকি। তা সেটি পৃথিবীর যে কোনো দেশেরই পতাকা হোক না কেন! কেননা একটি পতাকা একটি জাতির আত্মপরিচয় বহন করে। জাতীয় পতাকা স্বাধীনতা ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এবং সে জাতির মানুষেরা অনেক অনেক প্রাণের বিনিময়ে সে পতাকা অর্জন করেছেন- ঠিক যেভাবে আমরা আমাদের লাল-সবুজের পতাকাটি অর্জন করেছি, সেভাবেই।