অভিজিৎ রায় ছিলেন আগাগোড়া বিজ্ঞানের মানুষ। ছিলেন আমেরিকার নাগরিক। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বাইশ বছর আগে যখন বাংলাদেশের মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি ভালোভাবে বুঝেও ওঠে নি, সেই তখন কয়েকজন লেখকদের নিয়ে মুক্তমনা নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন তিনি। যখন স্মার্টফোন আসে নি, যখন কম্পিউটারে বাংলা ভাষায় লেখালেখি করার মতো পর্যাপ্ত সুবিধা তৈরি হয় নি, সেই তখন অভিজিৎ বাংলায় লেখালেখির ওই প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করলেন।
আজ থেকে ঠিক আট বছর আগে এই অমর একুশে বইমেলাতেই অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অভিজিৎ রায়কে কেন হত্যা করা হয়েছিল জানেন তো? কারণটি হলো তিনি লেখালেখি করতেন। তার লেখার বিষয় ছিল সংস্কারের বিরুদ্ধে এবং বিজ্ঞানের পক্ষে। বিজ্ঞানের প্রধানতম শর্তটি হলো বিজ্ঞান প্রমাণ চায়। আর সংস্কারের সবচেয়ে দুর্বল দিকটি হলো- সংস্কার কেবলই বিশ্বাসকে ভিত্তিকে করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার প্রমাণের কোনো দরকার পড়ে না। অভিজিৎ তার একটি লেখায় লিখেছিলেন,কোনো কারণ ছাড়াই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি হতে পারে… মহাবিশ্ব যে শূন্য থেকে উৎপন্ন হতে পারে প্রথম ১৯৭৩ সালে ‘নেচার’ নামক বিখ্যাত জার্নালে জানিয়েছিলেন এডওয়ার্ড ট্রিয়ন।
কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন হলো শূন্য থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি। প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। পরম শূন্য স্থানে এক সেকন্ডের বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে শক্তি কনা ও প্রতিকণা তৈরি হচ্ছে ও মুহুর্তের মধ্যে একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষের ফলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনার স্থায়িত্ব মাত্র sqrt(10)-21 সেকেন্ড। এটাই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন। তারমানে অভিজিৎ রায় আসলে নতুন কিছু বলেন নি। তিনি কেবল বিজ্ঞানের একটি মতবাদকে তুলে ধরেছেন। কাল যদি ভিন্ন কোনো মতবাদ নিয়ে প্রমাণসহ কেউ হাজির হয় তাহলে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনকে মুহূর্তের মধ্যেই বাতিল করে দেওয়া হবে।
কিন্তু সংস্কার তেমন কোনো ব্যাপার নয়। সংস্কার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকে কেবলই বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে। ধর্মের সঙ্গে সংস্কারের কোনো বিরোধ নেই, কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে আছে। আর এই বিরোধ আজকে থেকে নয়। সেই প্রাচীন থেকেই। প্রায় চারশ’ বছর আগে জিওর্দানো ব্রুনো বলেছিলেন, মহাবিশ্ব অসীম এবং এর কোনো কেন্দ্র নেই। আরও বললেন, সূর্য নয়, বরং পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। ব্রুনোর এসব কথাবার্তা খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থের মতবাদের বিপরীত ছিল। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা তখন খুব রেগে গেল। রেগে গিয়ে তারা ব্রুনোকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলল।
অথচ জিওর্দানো ব্রুনো কিন্তু নতুন কিছু বলেন নি। তিনি যা বলেছেন, কোপারনিকাসও একই কথা বলেছিলেন। ব্রুনো কেবল কোপারনিকাসকে সমর্থন করেছিলেন। তো অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। তিনি কেবল বিজ্ঞানীদের নানান তত্ত্ব নিয়ে লেখালেখি করেছেন। নিজে কোনো মতবাদ প্রচার করেন নি। কিন্তু তবু অভিজিতকে মেরে ফেলল। দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেলেও চারশ’ বছরে সংস্কারবাদীরা একই রকম রয়ে গেছে। না, হলো না। বরং আরও পিছিয়েছে। অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকেও তারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।
আদালত অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের মামলায় পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু অভিজিৎ তো তাতে ফিরে আসবেন না।
লেখালেখিটা অভিজিতের ধমনীতে বইতো। বই বেরুলেও ব্লগেও লিখতেন। হয়ত সেকারণেই তার নামের আগে ‘ব্লগার’ অভিধাটি যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে অভিজিৎ একলা নন, সেসময়টাতে আরও অনেক ব্লগার অভিধা যুক্ত লেখক খুন হয়েছেন। বিবিসি শিরোনাম করেছিল ‘সিরিজ ব্লগার হত্যাকাণ্ড’। অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছিল তখন। জীবন বাঁচাতে বহুজনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। তারা আর দেশে ফিরেছে কিনা জানা নেই। ফেরার কথা নয় অবশ্য। সেধে সেধে কে মরতে যাবে বলুন!
আট বছর আগে এই অমর একুশে বইমেলায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলেছিল, সেদিন অভিজিতের স্ত্রী বন্যাকেও কুপিয়েছিল। কিন্তু গুরুতর আহত হলেও মরে যান নি। প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। সেই দিনটি ছিল আজকের দিন- ২৬ ফেব্রুয়ারি। আজ অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু বার্ষিকী। অভিজিতকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলতে চাই, মানুষে মানুষে যেমন ভেদাভেদ আছে তেমনি চিন্তাতেও ভেদাভেদ থাকবেই। মানুষকে তার নিজের মতো করে ভাবতে দিতে হবে, বলতে দিতে হবে। এইটিই সভ্যতা। ভিন্নমত সহ্য না করা, নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে চাওয়াটা অসভ্যতা। আর নিজের মতামত মেনে না নিলে তাকে মেরে ফেলাটা হলো পাশবিকতা।
দেখা যাচ্ছে আমরা সভ্য হই নি। সভ্য হওয়ার প্রধানতম উপায়টি হলো জাতিকে শিক্ষিত করে তোলা। কাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, সনদ সর্বস্ব শিক্ষায় দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। গেল বছরে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির আলোচনা সভায় রাষ্ট্রপতি হামিদ শিক্ষা যাতে কোনোভাবেই সার্টিফিকেট-সর্বস্ব না হয়, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কথা হলো, দেশের রাষ্ট্রপতিই যদি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে থাকেন তবে সরকার কিংবা শিক্ষামন্ত্রী বারবার ঢেলে সাজিয়ে কোন্ ব্যবস্থা নির্মাণ করছেন?