‘গুরু’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। গুরু যাকে বলা হয় তিনি মূলত শিক্ষক। তিনি শিষ্যকে শেখান, পরামর্শ দেন, পথ দেখান এবং জ্ঞান আহরণে সহযগিতা করেন। তবে আক্ষরিক অর্থে গুরু আসলে অন্ধকার দূর করেন, শিষ্যের অন্তর থেকে, সমাজ থেকেও বটে। গুরু যাকে বলা হয় তিনি আধ্যাত্মিক জগতের পথ প্রদর্শক। অধ্যাত্মবাদের জ্ঞানের খোজ দেন তিনি। কিন্তু আমরা গুরু বলতে শিক্ষককেই বুঝি। শিক্ষককেই আমরা গুরুর আসনটি দিয়ে রেখেছি।
প্রচলিত ধারণাটি হলো শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেন যিনি তিনিই প্রকৃত মানুষ। এবং মানুষের মেরুদণ্ড তৈরি করে সচল ও সুস্থ রাখার কাজটি যনি করেন- শিক্ষক। আমরা বলি, মানুষ গড়ার কারিগর। প্রাচীন ভারতে শিক্ষকের মর্যাদা ছিল কিংবদন্তীর মতো। তখনও এখনকার মতো কাগজের বইপত্রের যুগ শুরু হয় নি। শিষ্যদের লেখাপড়া বলত গুরুগৃহে। রাজরাজরাদের সন্তানেরা বিদ্যাচর্চা করতে চলে যেত গুরু। রাজা-মন্ত্রিরা নিজের নিজের ছেলেদের নিয়ে এসে হাত জোড় করে প্রার্থনা জানাতেন। অনুনয় করতে বলতেন গুরু তার সন্তানের দায়িত্বটি নেন। রাজপুত্র, মন্ত্রিপুত্ররা গুরুর কুটিরেই থাকত, গুরুর সেবা করে জ্ঞানার্জন করত। সে যুগকে বলা হতো সত্য যুগ। এখন সত্য যুগ নেই। আমাদের যুগটি আধুনিক যুগ। বড় যান্ত্রিক এই যুগ। আমরা যান্ত্রিক মানুষ বলে এখন কারও শিক্ষকের সেই মর্যাদাও নেই।
আর শিক্ষকেরাই কি অর্জিত সেই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছেন? ছেলেবেলায় আমরা একটি ভাবসম্প্রসারণ পড়েছিলাম- ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। মর্যাদাও
তাই নয়? অর্জনই শেষ কথা নয়, অর্জিত যা কিছু , তাকে রক্ষা করতে হয়।
মধ্যযুগের কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের বন্দনা কবিতাটি মনে আছে? কবিতাটি আমাদের পাঠ্য ছিল। সেখানে একটি লাইন ছিল, ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়।/ দোসর-জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার।।’
জন্মদাতা পিতা শুধু জন্ম দিয়েই থাকেন; কিন্তু তাকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তোলেন তার শিক্ষক। জ্ঞান বা বিদ্যার্জনের জন্য শিক্ষকদের ভূমিকাকে দ্বিতীয় জন্মদাতার সঙ্গে তুলনা করে এই কথা লিখেছেন শাহ মুহম্মদ সগীর।
যতদিন শিক্ষকের সেই মর্যাদা ফিরে না আসবে ততদিন আমাদের সমাজ ভূতের মতো উলটো দিকেই হাঁটতে থাকবে। এই ফিরিয়ে আনবার দায়টি কারও একলার নয়- শিক্ষকের যেমন, তেমনি আমাদেরও। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলেরই। শিক্ষামন্ত্রীরও বটে।
99
previous post