জয় হোক শুভশক্তির

0 comment 101 views

শ্রাবণ শেষে ভাদ্র। ভাদ্রের পরেই আশ্বিন। ভাদ্র-আশ্বিন এই দু মাস মিলে শরৎকাল। শরৎ মানেই আগে থেকে জানান না দিয়ে হঠাৎ এক পসলা বৃষ্টি। এরপর আবার রোদের খেলা। সকালের মেঘ-বৃষ্টি পেরিয়ে দুপুরে কড়া রোদের ঝলক। সন্ধ্যায় আবারও মেঘের আনাগোনা। শরৎ মানে নদী তীরে কাশফুল, গাছে গাছে শিউলি, বেলির সঙ্গে আরও নানান জাতের ফুল। আর জলে শাপলা ফুল। কৃষকের তখন নতুন ধান। পুকুরপাড়ের তালগাছে পাকা তালের মিষ্টি গন্ধ। সেই পাকা তাল দিয়ে নতুন ধানের চালে ঘরে ঘরে পিঠা, পায়েস।

শুধু কি এটিই শরৎকাল? তা নয় কিন্তু। শরতে হয় শারদীয় পূজা। পূজা তো আসলে দেবী দুর্গার। কিন্তু শরৎকালে এর উদযাপন বলে এই পূজার আরেক নাম শারদীয়া। দুর্গাপূজার হিসেবটা বাংলা বর্ষপঞ্জিতে করা হয়। বাংলা সালের আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে পূজা দশ দিনের উৎসব। এই শুক্ল পক্ষটির নাম ‘দেবীপক্ষ’। আর দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া। আশ্বিন মাসে নবরাত্রির পূজাটিই মূলত শারদীয় পূজা। বাঙালীর অন্য্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব। বস্তুত কৃত্তিবাসী রামায়ণে লিখেছে, রামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে শরৎকালে দেবীর পূজা করেছিলেন। তখন থেকে এর নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গাপূজা।

শারদীয়া দুর্গাপূজার এই যে বর্ণনা- এটি আমাদের বই পড়ে শিখতে হয় নি। আমরা ছেলেবেলায় ধর্ম নিয়ে নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথা ছিল না। যে যার ধর্ম নিজের মতো পালন করবে, অথবা করবে না- এটা নিয়ে কাউকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখি নি। ফলে ছেলেবেলা থেকে যেভাবে আমরা বড় হয়ে উঠেছি, এসব আমাদের সময়ের সকলেরই জানা হয়ে যেত। সনাতন ধর্মীয় বন্ধুদের কাছে আমরা নানান মুখরোচক খাবারের দাবি তুলে বলতাম, এবারের পূজায় যদি নিমন্ত্রণ না করিস্‌ তাহলে ঈদ এলে তোকে চিনতেই পারব না! আবার সনাতন ধর্মীয় বন্ধুরা কোরবানি ঈদ এলে সকৌতুকে আমাদেরকে বলত, ওই শোন্‌, তোরা কি এবার গরু না ছাগল? বলেই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ত।

আমাদের এক সনাতন ধর্মীয় বন্ধুর মা রোজ সন্ধ্যায় আরতির পর সাজ্জাদের কপালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে দিতেন। আমরা চুপি চুপি মুখ টিপে হাসতাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে হাসতে বলতাম, চন্দনের ফোঁটা মুছিস্‌ নি সাজ্জাদ, অমঙ্গল হবে। সাজ্জাদ খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাত, কিন্তু চন্দনের ফোঁটা মুছত না। বলত, দেখ, আমসী ভালোবেসে ফোঁটা দিয়েছেন, অসন্মান করবি না। তোরা এমন করলে কালকে মাসীকে বলে দেব। সাজ্জাদের এই হুমকি খুব কাজে দিত। আমাদের কেউ ফোঁটা নিয়ে আর কথা বলত না।

কিন্তু সনাতন ধর্মটা এখন এখন হয়ে গেছে হিন্দু ধর্ম। অথচ হিন্দু কোনো ধর্মের নাম নয়। হিন্দু আসলে জাতির নাম। যারা হিন্দুস্তানের মানুষ তারাই হিন্দুস্তানি। সংক্ষেপে হিন্দু। যখন থেকে ভারতবর্ষের মানুষদের রক্তে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকেছে তখন থেকেই জাতি আর ধর্ম গুলিয়ে গেছে।

দুর্গাপূজা প্রধানত বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। দুর্গা পৌরাণিক দেবতা। দুর্গ বা দুর্গম নামক দৈত্যকে বধ করেন বলে তাঁর নাম হয় দুর্গা। জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেও তাঁকে দুর্গা বলে ডাকা হয়। মহিষাসুর নামে এক দানব ছিল। সে স্বর্গরাজ্য দখল করে রেখেছিল। কিন্তু তাকে হত্যা করা যা না। দেবতা ব্রহ্মা মহিষাসুরকে বর দিয়েছিল কোনো পুরুষ তাকে হত্যা করতে পারবে না। তখন স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত দেবতারা বিষ্ণুর কাছে গেলেন। বিষ্ণুর নির্দেশে সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে জন্ম হলো দেবী দুর্গার। এরপর দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করলেন। একারণেই দুর্গাপূজার এই উৎসব খারাপ শক্তির বিনাশ করে এবং শুভশক্তির বিজয় হয় বলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন।

এই বিশ্বাস আমাদের জন্যে অর্থবহ। এই বিশ্বাসটুকু আমাদের জানায়, পৃথিবীতে এখনও বেশিরভাগ মানুষ অশুভ শক্তির বিনাশ কামনা করে শুভশক্তির বিজয় চায়।

আদিকবি ঋষি বাল্মীকি যখন রামায়ণ রচনা করেন, তিনিও তখন আপনা আকাঙ্ক্ষায় শুভশক্তির পক্ষেই ছিলেন। তিনি সম্পর্ক দায়িত্ববোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর তিনি কাব্যে নানান সম্পর্কের পারস্পরিক কর্তব্য বর্ণনা করেছেন। আদর্শ স্বামী, ভাই, স্ত্রী শাসক- সর্বোপরি আদর্শ মানুষের ছবি এঁকেছেন। এবং তাদের দিয়ে আদর্শ সমাজিক ব্যবস্থার বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন।

সব বছরের মতো এবারেও দেবী দুর্গা আসুন, বধ করুন মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা মহিষাসুরকে। জয় হোক শুভশক্তির। সবাইকে শারদীয়া দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা।

শাহ্‌ জে. চৌধুরী

Leave a Comment

You may also like

Copyright @2023 – All Right Reserved by Shah’s Writing