একটি ইতিহাস লেখা হবে, তার জন্যে অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল মানুষ ছুটে এসেছেন নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস, জর্জিয়া, ওয়াশিংটের সঙ্গে আমেরিকার আরও আরও রাজ্য থেকে। যেখানেই বাংলাদেশের মানুষেরা আছেন, সকলে এসে জড়ো হয়েছেন ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে। সকলেই সাক্ষী হতে চান সেই ইতিহাস লেখা ক্ষণটির। আজ। ঠিক এই মুহূর্তে আমারও ওই ঐতিহাসিক ক্ষণটির কথাই মনে পড়ছে। দিনটি ছিল ২০১৮ সালের ১২ মে। শনিবার। বিকেল ৪টা। আমরা খুব উত্তেজনায় প্রহর গুনছি। সবাই রুদ্ধশ্বাস। আর কিছুক্ষণেই ইতিহাস রচিত হবে। সেই রচনায় অংশ নিতে ঢাকা থেকে ফ্লোরিডা এসেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। এসেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, এসেছেন তখনকার বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ। এবং তাদের অনেক সঙ্গীরা।
কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তটিতে, ওই মাহেন্দ্রক্ষণটিতে, ’১৮ সালের ১২ মে বিকেল ৪টা ১২ মিনিটে এই মানুষগুলোর কেউ মন্ত্রী নয়, সংসদ সদস্য নয়, বিটিআরসির চেয়ারম্যান নয়, কিছুই নয়। এমন কি কেনেডি স্পেস সেন্টারে অধীর হয়ে অপেক্ষায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তাঁর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও তখন কেউ নন, কিছুই নন। এঁদের সকলেরই তখন একটাই পরিচয়- এঁরা বাঙালি। এঁরা সকলে বাংলাদেশের মানুষ।
আমার নির্মলেন্দু গুণের কবিতা মনে পড়ল-
‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে…
…শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা- ;
কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি:
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এই কবিই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। এই কবির স্বপ্নই আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে, পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে ডানা মেলল আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে। পৃথিবীর একশ’ ছিয়ানব্বইটি দেশের মাঝে ছাপান্নটি দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ ‘বঙ্গবন্ধু ১’ স্যাটেলাইটটি নিয়ে সাতান্নতম গর্বিত মালিকানা নিয়ে যুক্ত হলো ছাপান্নর সঙ্গে।
নাসা এইসব বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্যে ‘বঙ্গবন্ধু ১’ স্যাটেলাইট অবলোকন ও উৎক্ষেপণ দৃশ্যটি দেখার সুযোগ রেখেছিল। আমরা সুযোগটি ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। এই সুযোগটি ব্যবহার করবার গল্পটি এখন মনে পড়ল।
ক’দিন আগের কথা। রোজকার মতোই নিউ ইয়র্কের প্রখ্যাত খাবার বাড়ি রেস্টুরেন্টে সাংবাদিকদের আড্ডা চলছিল। সেদিনের আড্ডার প্রধান আলোচ্য ছিল বাংলাদেশের নিজের একটা স্যাটেলাইট হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি ঘটনা। আমরা যারা দেশের মাটি থেকে এই এতটা দূরে থাকি তারা এমন অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাই প্রত্যক্ষ করতে পারি না। যেমন রাজাকারদের ফাঁসি, কিংবা আনুষ্ঠানিকভাবে যখন সাবমেরিন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী; অথবা প্রধানমন্ত্রী যখন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৬৮ বছরের মানবিক সঙ্কটের সমাধান করলেন, আমরা নিউ ইয়র্কের সাংবাদিকরা সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে থাকতে পারি না। কিন্তু এই যে ‘বঙ্গবন্ধু ১’ স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ হতে যাচ্ছে, এটা তো এই আমেরিকার মাটিতেই! আমাদের তো সুযোগ রয়েছে ফ্লোরিডার নাসা সেন্টারে গিয়ে এই ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সহযোগী হওয়ার!
অতঃপর তক্ষুনি, খাবার বাড়ি রেস্টুরেন্টের সেই আড্ডাতেই, সেদিনই আমরা, নিউ ইয়র্কের সকল সাংবাদিকরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে, আমরা সকলে ফ্লোরিডা যেতে চাই, আমরা সবাই মিলে নাসা থেকে ‘বঙ্গবন্ধু ১’ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঐতিহাসিক ক্ষণটির প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে চাই। তারপর নির্দিষ্ট দিনটির আগেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম ফ্লোরিডা। আর সকলের সঙ্গে আমার সঙ্গী হয়েছিলেন দেশকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক দর্পণ কবির। তাঁকে কৃতজ্ঞতা।
কৃতজ্ঞতার কথা যেহেতু চলেই এল, তাহলে আরও একজন মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। তিনি ড. শাহজাহান মাহমুদ। সে সময় শাহজাহান ভাই বিটিআরসির চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন তিনি বাংলাদেশ কমিউনিকেশন্স স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান। আমার সবসময়েই মনে হয়েছে শাহজাহান ভাই এতদিনে নিজের কাজের সঠিক জায়গাটিতে গিয়েছেন। আমি নিশ্চিত জানি শাহজাহান ভাই আমাদের স্যাটেলাইটের সর্বোচ্চ সুবিধা আর সুফলটুকু ঠিকই নিংড়ে বের করে আনবেন।
স্যাটেলাইটের এই সফল উৎক্ষেপণ আমাদের জন্যে একটা অহংকার মেশানো গৌরবের ব্যাপার। কেননা বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইটটি বাংলাদেশের টেলিভিশন, ইন্টারনেট সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার পথ সুগম করেছে। এবং স্যাটেলাইটটি যখন স¤পূর্ণ কাজ শুরু করবে তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো যাবে খুব সহজেই। আর স্যাটেলাইট টিভির ডিটিএইচ- ডিরেক্ট টু হোম ডিশ সার্ভিস বা কেবল টিভির সংযোগের উন্নত সেবা চালু করবে। এর ফলে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারের সঙ্গে ভি-স্যাট ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদানকারীদের কাজেও ব্যবহার করা যাবে।
আরও আছে। বাংলাদেশের প্রতিটি টেলিভিশন স্টেশন প্রতি মাসে ২৪ হাজার ডলার দিচ্ছে বিদেশি স্যাটেলাইট কোম্পানিকে। যার ফলে বাংলাদেশের সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেল বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া হিসেবে প্রতি মাসে মোট খরচ করছে প্রায় ১৫ লক্ষ ডলার। বিপুল অংকের এই টাকাটা এখন সাশ্রয় হবে।
ফাইবার অ্যাট হোম প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সুমন আহমেদ সাব্বির আমাদের জানিয়েছেন, এখন স্যাটেলাইট প্রযুক্তি নির্ভর আরও অনেক শিল্প গড়ে উঠবে। জিপিএস নির্ভর স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং নির্ভরসহ নানা ধরনের ব্যবসা তৈরি হয়েছে। সেগুলো হয়ত একটা স্যাটেলাইটে হবে না, ভবিষ্যতে আরও মাল্টিপল স্যাটেলাইটের প্রয়োজন হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেল জুনে সংসদ অধিবেশনে সে আশা আরও উসকে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ১-এর ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট তৈরির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
আমরাও প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, সাগরের তলদেশ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত বাংলাদেশের মর্যাদাকে উন্নত করেছি। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখুন।
শেষে এসে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই ‘দেশকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক দর্পণ কবীরকে। প্রথমত, দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এই আমেরিকার মাটিতে শত ব্যস্ততা মাঝেও তিনি দেশকে শুধু মনে রেখেছেন, তা নয়; দেশের প্রতি যে তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে স্বদেশের কণ্ঠের আপন কন্ঠে মিশিয়েছেন। আর দেশের সেই কণ্ঠ ছড়িয়ে দিতে নিরলসতায় প্রকাশ করে চলেছেন ‘দেশকণ্ঠ’ পত্রিকাটি।
এবং দ্বিতীয়ত, আজকে আমাকে এই কথাগুলো বলবার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। দর্পণ কবীর আমার কাছে লেখা না চাইলে হয়ত এই কথাগুলো আমার কখনই বলা হয়ে উঠত না।
আজ দর্পণ কবীর সম্পাদিত ‘দেশকণ্ঠ’র বছর পূরণের দিন। দর্পণ তাঁর দেশের কণ্ঠ একদিন আকাশের ওপারের আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে পৌঁছে দিক।
অনেক শুভেচ্ছা আর শুভকামনা।
প্রকাশকাল: দেশকণ্ঠ, অক্টোবর ২০১৭।